তুমি ফিরবে বলে (বোনদের জন্যে) বই থেকে একটুখানি

ইদানীং সিনেমার হট টপিক হলো ‘আইটেম সং’। যেসব হিন্দি সিনেমা রমরমা ব্যবসা করতে চায়, তার প্রায় সবগুলোতেই এসব নষ্টামো থাকে। এখানে যে নাচে, তাকে বলা হয় ‘আইটেম গার্ল’। একটা স্বল্পবসনা নারী নানান অঙ্গভঙ্গি করতে থাকে পুরুষদের সামনে। সুরের মূর্ছনায় যৌন-উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয় দর্শকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। দর্শকে কামাতুর করাই এসব গানের মূল উদ্দেশ্য।
.
আগেকার দিনের বাইজিদের সাথে এদের কোনো পার্থক্য আছে কি?
একসময় বাইজি নামক একদল ললনার দেখা মিলত সমাজে। ওদের মহলে নিয়মিত যাতায়াত করত রাজা-বাদশাহরা। বাইজিনাচ আর সুরমূর্ছনায় যৌনসুখ খুঁজে নিত তারা। অনেক রাজার আবার জমকালো রঙ্গমহল থাকত। রাতেরবেলা সে মহল মুখরিত করে রাখত নর্তকীরা। মন্ত্রী-শেঠ-উজির-সহ অনেককেই নেমন্তন্ন করা হতো সেখানে। ঝুমুরঝুমুর নাচ দেখে দেখে নেশার ঘোরে হারিয়ে যেত অতিথিরা। অনেকেই আবার বাইজিদের শয্যাসঙ্গী হতো।
.
এখনকার দিনে বাইজি নেই, আছে বাইজির নৃত্য। মোবাইল, টিভি কিংবা পিসির স্ক্রিনগুলো নাচানাচির আড্ডাখানা। প্রতিটি মানুষ আধুনিক বাইজির নৃত্য দেখে সাধ মেটায়। অল্প টাকার মেইগাবাইট কিনে জন্মের মতো উপভোগ করে নারীদেহ। কল্পলোকে হারিয়ে যায় সুদূর দূরে।
তোমার দাদি-নানিদের জিজ্ঞেস কোরো তো, যেসব নারীরা যাত্রাপালায় অংশ নিত সমাজ তাদেরকে কোন চোখে দেখত?
.
আগেকার দিনে বাইজি-নর্তকীরা মুখ দেখাতে পারত না সমাজে। কিন্তু আজ তারা বাহবা পায়। আইটেম সং, মুভি কিংবা কনসার্টের মতো আধুনিক যাত্রাপালায় যারা নেচেগেয়ে বেড়ায়, এরাই হয়ে গেছে নারী-জাতীর আদর্শ। রমণীরা আজ এদের মতো হতে চায়। এদের পোশাক-আশাক, ফ্যাশন, স্টাইল অনুসরণ করে পদে পদে। কবে থেকে বাইজিদের দাম এতটা বেড়ে গেল? আইটেম গার্লের পদ কবে থেকে এতটা সম্মানিত হয়ে গেল?
.
আফসোস! তোমরা কি পাশ্চাত্যের কাছে নিজের বিবেক বন্ধক রেখেছ? কেন ‘মিস ইউনিভার্স’ হওয়ার স্বপ্ন দেখো? সবকিছু বিকিয়ে দিয়ে যে ওখানকার শিরোপা জিততে হয়, জানো তো? আমি বললে হয়তো বিশ্বাস করবে না। চলো, একজন সাবেক মিসের জবানেই শুনি সেই কাহিনী। লাক্স তারকা মম বলেছে, ‘পৃথিবীব্যাপী সুন্দরী প্রতিযোগিতা হচ্ছে একটা ব্যবসা। মেয়েরা হচ্ছে ব্যবসার উপকরণ। ছোট কাপড়ের মেয়েরা ব্যবসার ভালো উপকরণ। আর বড় কাপড়ের মেয়েরা ব্যবসার অপেক্ষাকৃত কম উপকরণ। আমি নিশ্চয় বিষয়টা বোঝাতে পেরেছি। তাই সুন্দরী প্রতিযোগিতা শুধু ব্যবসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর চেয়ে বেশি কিছু না।… সুন্দরী প্রতিযোগিতা নাকি ষোড়শী ছাড়া হয় না।… কারণ অল্প বয়সী মেয়েদের পিক করা হয় বিপথগামী করার জন্য। যারা বুদ্ধিমান, যারা বিচক্ষণ তারা হয় তো ওই ট্র্যাপে পা না দিয়ে নিজের একটা আইডেন্টি তৈরি করতে চেষ্টা করে। কিন্তু প্রধান উদ্দেশ্য থাকে অল্প বয়সী ষোড়শী সুন্দরীদের নিয়ে ব্যবসা করা।’
.
নায়কের বয়স পঞ্চাশ হলেও সমস্যা নেই, কিন্তু নায়িকাকে হতে হবে টসটসে যুবতী। ষাট ছুঁই ছুঁই করা টম ক্রুজ বা পঞ্চাষোর্ধ আমির খান—কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আইটেম সং চালানোর জন্যে লাগবে পূর্ণ যৌবনা, উর্বষী কোনো নারী। নয়তো জমবে না ব্যবসা। হিট হবে না সিনেমা।
.
তোমাদের আবেগ নিয়ে খেলছে বেণিয়ারা। ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে, আর বেলাশেষে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে ডাস্টবিনে। নারী যতদিন বাজার গরম রাখতে পারবে, ততদিন সে দামি। যতদিন তাকে দিয়ে রমরমা ব্যবসা চলবে, ততদিন তাকে কদর করবে বেণিয়ারা। কিন্তু যৌবন ফুরিয়ে গেলে ছুড়ে ফেলবে টয়লেট টিস্যুর মতন। যদি জনপ্রিয় হতে চাও, তবে বিকিয়ে দিতে হবে নিজের সম্ভ্রম। নিজের অদেখাকে খুলে দেখাতে হবে দর্শকের সামনে। পরিচালকের সাথে রাত কাটানো ছাড়া মিলবে না অভিনয়ের সুযোগ। না, এ কথা আমার না। অভিনেত্রী কঙ্গনা রনৌত বলেছেন, নায়িকা মানেই পরিচালকের কোলে বসতে হবে।
কত ধুরন্ধুর ব্যক্তি যে ফাঁদ পেতে রেখেছে মিডিয়া-জগতের আনাচে-কানাচে, হয়তো জানোও না। হলিউড-বলিউড হলো যৌন হয়রানির আখড়া। হাতেগোনা কজন বাদে, সবাই জড়িয়ে গেছে ধর্ষণ কিংবা ব্যভিচারে। যারা স্বেচ্ছায় রাজি হয়নি, তাদেরকে বাধ্য করা হয়েছে। হার্ভে ওয়েনস্টেইন, কেভিন স্পেইসি, বেন এফ্লেক, জর্জ ডাব্লিউ বুশ সিনিয়র, ক্রিয়া সাভিনো, রয় প্রাইস-সহ বাঘা বাঘা লোকেরা জড়িয়ে আছে এসব অপরাধের সাথে। হলিউডের চলচ্চিত্র পরিচালক জেমস ট্যাবোকের নামে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছে ৩৮ জন নারী!
.
একটা খবরের কিছু অংশ শোনাই :
“আজ রোববার, ৭১তম বাফটা অ্যাওয়ার্ডের পর্দা উঠতে যাচ্ছে। এ বছর পশ্চিমের প্রতিটি পুরস্কার বিতরণী আসর অন্যগুলো থেকে আলাদা। হলিউডের যৌন হয়রানি আর এর প্রতিবাদের প্রভাব গিয়ে পড়েছে সব জায়গায়। সম্প্রতি সমাজের সব ক্ষেত্রে নারীর ওপর যৌন হয়রানি ঠেকাতে যুক্তরাজ্যের ২০০ নারী তারকা একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। যুক্তরাজ্যের ‘দ্য অবজারভার’ পত্রিকায় সেই চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। সাক্ষরকারীদের মধ্যে আছেন ব্রিটিশ টিভি, চলচ্চিত্র ও মঞ্চের অভিনেত্রী। নায়িকা এমা টমসন, কিরা নাইটলি ও এমা ওয়াটসন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।”
.
এই বিপথগামী নারীরাই আবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লেজ হারানো শিয়ালের মতো লেজ না থাকার ফজিলত বয়ান করে বেড়ায়! আর তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তরুণীরা লাইন লাগায় সম্ভ্রম বিকানোর প্রতিযোগিতায়। “প্রথম বার এসেছি, কিন্তু শেষ বারের জন্য নয়”, “দেখিয়ে দাও অদেখা তোমায়”—এসব চটকদার স্লোগানের খই ফুটে মুখ দিয়ে। পোকামাকড় যেমন আগুনে ঝাঁপ দেয় আশ্রয়ের খুঁজে, ঠিক তেমন করে তরুণীরাও ফেইমের জন্যে ঝাঁপায় যৌনতার অকূলপারাবারে। আর রবীন্দ্রনাথের মতো গাইতে থাকে—
ডুবিয়ে তরী ঝাঁপিয়ে পড়ি ঠেকব চরণ-‘পরে,
আমি বাঁচব চরণ ধরে।
.
আজ তোমার কী হলো? কেন আল্লাহভীতির জায়গায় আল্লাহদ্রোহী হবার নেশায় মত্ত হয়ে গেলে? আলোকোজ্জ্বল পথ ছেড়ে আঁধারের দিকে কি কেউ জেনেশুনে পা বাড়ায়? পাগলও তো তালে ঠিক থাকে। কিন্তু তুমি? তুমি তো পাগল নও। তবে এতটা অধঃপতন কী করে হলো তোমার?
বোন আমার, তোমার রব তোমাকে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বানিয়েছেন। না, তোমার সৌন্দর্যের জন্যে না। রূপলাবণ্যের জন্যেও না। তুমি শ্রেষ্ঠ, কারণ তোমার আত্মমর্যাদা আছে। তোমার কাছে আছে ঈমান। আছে আয়িশা, ফাতিমা কিংবা খাদিজার মতো মহিয়সী নারীদের আদর্শ। তুমি পৃথিবীসেরা সভ্যতার অনুসারী। এরপরেও কি অসভ্যতার অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে নিজেকে নিঃশেষ করে দেবে?
.
.

তুমিফিরবেবলে (বোনদের জন্যে) বই থেকে একটুখানি…

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *