অফলাইন দাওয়াহ

SHAMSUL AREFIN SHAKTI·FRIDAY, MARCH 8, 2019

 – মুসলিমের সন্তান মুসলিম থাকবে কি না

– কাফিরের সন্তান মুসলিম হবে কি না

দুটোই নির্ভর করে একটা আমলের উপর— দাওয়াহ। সব নবীর উম্মত গোমরাহ হবার আগে মুসলিমই ছিল। দাওয়াহর অভাবে কাফির হয়ে গেছে মুসলিমদের পরবর্তী প্রজন্ম। আবার নবী এসেছেন। দাওয়াহ শুরু হয়েছে, কাফিরের সন্তানেরা মুসলিম হয়েছেন। দাওয়াহ না থাকলে মুসলিম বংশের সন্তানও নাস্তিক-মুরতাদ হয়ে যাবে। ইসলামের শুরু থেকে দাওয়াহ গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এখনও গুরুত্বপূর্ণ, কিয়ামত পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বোচ্চ লেভেলের গুরুত্বপূর্ণ আমল। দাওয়াহ কার্যক্রমের মজবুতির উপর নির্ভর করবে আপনাদের মসজিদে কত লোক আসবে, আপনাদের মাদরাসাগুলোতে কতজন তাদের ছেলেকে পড়াবে, খানকাহগুলোতে কী পরিমাণ লোক আত্মশুদ্ধির জন্য আসবে, ইসলামী দলের ভোট সংখ্যা কত হবে। ভোট জায়েজ-নাজায়েজ আমার আলোচ্য নয়। আমার পয়েন্ট হল- ইসলাম প্রতিষ্ঠার  প্রচেষ্টাগুলো কত বেগবান হবে, তা নির্ভর করে সমাজে দাওয়াহ ওয়ার্ক কতটা স্ট্রং তার উপর। এজন্য উপমহাদেশেই যদি তাকাই (যেহেতু বাইরের বিপ্লবগুলো অতটা জানি না) ফরায়েজী আন্দোলন বলেন, সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহঃ এর আন্দোলন বলেন, এক্সটেনসিভ দাওয়াহ ওয়ার্কই ছিল সাফল্যের ভিত। এমনকি মওদূদী রহঃ এর শুরুটা ব্যাপক জনসংযোগ, আইমিন দাওয়াহভিত্তিকই ছিল। বর্তমান কওমী রাজনৈতিক  দলগুলোর কঙ্কালসার শরীরের পিছনে রোগও এটাই, জনবিচ্ছিন্নতা। আর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (চরমোনাই) এর কিছুটা সাফল্যের পিছনে কারণ এটাই যে, ব্যাপক দাওয়াহ তাদের সাংগঠনিক কাজের অংশ। আমার মনে হয় আমি বুঝাতে পেরেছি, বর্তমান প্রেক্ষাপটে জনমনে ইসলামের আবেদন ফেরাতে ইসলামিস্টদের একমাত্র মনোযোগ হওয়া উচিত- ব্যাপক দাওয়াহ। 

এখন দেখি, দাওয়াহ কী? দাওয়াহ হল আহ্বান। ইসলামের দিকে আহ্বান, মানহাজ-প্রার্থী-সংগঠনের দিকে না। যে যেকোন ভাবে ইসলামের দিকে আহ্বান করছে, এটা দাওয়াহ। মুআযযিনের আযান, উলামাগণের দরস-ওয়াজ-বাহাস-লেখনী-সাময়িকী-টিভি প্রোগ্রাম, মুবাল্লিগদের ডোর-টু-ডোর মেহনত, মুজাহিদের তরবারি। সবই দাওয়াহ। নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে গিয়ে প্রার্থীর ভোট চাওয়া, এটাকে আসলে ঠিক দাওয়াহ বলা যায় না। দাওয়াহ হবে ইসলামী চেতনার, ইসলামের। সারাবছর ফিল্ডওয়ার্ক করে তারপর না বছর শেষে রেজাল্ট আসবে? ঠিক ভোটের আগে যাই বলেই কাঙ্খিত রেজাল্ট আসে না। জনগণের ভিতর ব্যাপক দাওয়াহর দ্বারা ইসলামী চেতনা জাগান, ইসলামের টোটাল সমাধান পাওয়ার পিপাসা জাগান, বুঝান যে ইসলামেই তোমার সমস্যার সমাধান। তাহলে যে ডালি আপনি সামনে ধরবেন, তাই ভরে উঠবে, মসজিদ-মাদরাসা-খানকাহ-রাজনীতি, যেটাই ধরবেন।

এবার একটা সহজ উদাহরণ।

সিনারিও এক. মহল্লার স্বল্পপরিচিত কোন মুসল্লি, এই জাস্ট মসজিদে দেখা হয়, সালাম বিনিময় হয়। ফোন করেছে, ভাই অমুক দিন আমার মেয়ের বিয়ে অমুক কম্যুনিটি সেন্টারে, আপনি এলে খুব খুশি হব। বা কাউকে দিয়ে একটা কার্ড পাঠিয়ে দিল।

সিনারিও দুই. হঠাৎ কলিংবেল। ভদ্রলোক নিজেই হাজির। হাতটা ধরে- ভাই আমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে। আপনি অবশ্যই আসবেন। আপনি এলে কী যে খুশি হব। আসবেন কিন্তু।

কোনটা বেশি প্রভাব ফেলবে আপনার উপর? প্রথমটা আপনার মনেই থাকবে না। কত দ্রুত মন থেকে বা ‘প্রায়োরিটি লিস্ট’ থেকে এটা উধাও হবে তা নির্ভর করবে স্বল্পপরিচয়, বিয়ের দিন বেশি কাছে হলে, সেন্টার দূরে হলে। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আপনি যাওয়ার খুব চেষ্টা করবেন, যেহেতু নিজে এসে দাওয়াত দিয়েছে। যদি যেতে নাও পারেন, আপনার ভিতর একটা অপরাধবোধ কাজ করবে। ঐ ভদ্রলোক এর পরে কোন অনুরোধ করলে আপনি ফেলতে পারবেন না। এজন্য ‘আমার মনে হয়’ সশরীরে দ্বারে দ্বারে দাওয়াহ অন্যান্য সকল মাধ্যমের তুলনায় বেশি ইফেক্টিভ। অথচ, কিছুটা কঠিন বলে সব মানহাজে এই সাইডটা অবহেলা করা হয়। মওদূদী সাহেবের ফরমেটেও এটা একসময় জোরালোভাবে ছিল, পরে ধীরে ধীরে উপেক্ষিত হয়ে গেছে। এবং যত সফল বা প্রায় সফল বিপ্লব হয়েছে, আপনারা দেখবেন এই সশরীরে দাওয়াহ সেগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে ছিল।   

এই সশরীরে দাওয়াহ কেবল প্রচারই নয়, আত্মশুদ্ধিরও মাধ্যম বটে। নফসকে কাবুতে আনার আমল। ইসলাম গ্রহণের পর সাহাবাদের গণআত্মশুদ্ধি দাওয়াহর দ্বারা হয়েছে। হায়াতুস সাহাবাহ ১ম খণ্ড, পৃঃ ৮০-১৬০ তে দেখুন এক এক সাহাবী নবীজীর কাছে এসে ইসলাম কবুলের পর তাকে নিজ কওমের কাছে দাওয়াতে পাঠানো হয়েছে, দাওয়াতও চলেছে, ঐ নওমুসলিম সাহাবীর মজবুতিও এসেছে। কীভাবে ব্যাপক প্রচার, প্রত্যাখ্যান ও নির্যাতনের দ্বারা তাদের ঈমান পোক্ত হয়েছে, নফসের উপর দীনকে প্রাধান্য দেবার শক্তি তৈরি হয়েছে। যদিও আজ আত্মশুদ্ধি বলতে আমরা কিছু ইন্ট্রোভার্ট আমল বুঝি, সাহাবীদের আত্মশুদ্ধি ছিল এক্সট্রোভার্ট, দাওয়াহ ও জিহাদের মাধ্যমে— গণআত্মশুদ্ধি। দাওয়াহর জন্য নিজে উপযাচক হয়ে ছোট হয়ে যাওয়া নফসের জন্য ভারি, দাওয়াহ করতে গিয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া-অপমান সহ্য করার দ্বারা এবং একই কথা বারবার জবানে বলার দ্বারা অন্তরে বসে যাওয়া আত্মশুদ্ধির মাধ্যম। ইসলামে আসার পর সাহাবীদের গণতরবিয়ত মক্কায় হয়েছে দাওয়াতের দ্বারা, মদীনায় জিহাদের দ্বারা। জিহাদে পরিবার-জীবিকা ছেড়ে বের হওয়া নফসের জন্য কষ্টকর, কষ্ট সহ্য করা, সার্বক্ষণিক মৃত্যুভয় এবং স্বচক্ষে আল্লাহর মদদ দেখা জিহাদে গণআত্মশুদ্ধির কারণ হয়েছে। নবীজী আমাদের একটা সামগ্রিক মেহনত শিখিয়েছিলেন।  এক ঢিলে বহু পাখি। প্রচার, ইসলাহ, সমাজমানস গঠন, শেখানো। সব একসাথে। এজন্যই সবার সমাজবিপ্লবের নকশায় দাওয়াহ এক নম্বর পয়েন্ট হিসেবে থেকেছে। সাইয়েদ কুতুব থেকে মওদূদী, সাইয়েদ আহমাদ শহীদ থেকে ইলিয়াস রাহিমাহুল্লাহ। আমার মতে, ইসলামের সব প্রচেষ্টাগুলোতেই এখন ব্যাপকভাবে এই অংশটা জোরদার করা দরকার- সশরীরে দাওয়াহ। এবং অবশ্যই বিতর্কিত কোনো বিষয়ে না,  নিজ সংগঠনের দিকে নিজ মানহাজের দিকে না; দাওয়াহ হবে বেসিক ইসলামের- বেসিক তাওহীদের (তাওহীদের ব্যাখ্যা লেভেলে আবার মতভিন্নতা আছে)। লোকদের মধ্যে ইসলামে বাতলানো সমাধানের পিপাসা তৈরি করতে হবে। আর তার গেট হল তাওহীদ। যে তাওহীদের গেট দিয়ে ঢুকবে, সে সমাধান পাবে। ক্বুলু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু তুফলিহু, সফল হয়ে যাবে। ইসলামের পিপাসা সমাজে সৃষ্টি হলে দীনের সব প্রচেষ্টায় জোয়ার আসবে।    

দীন পালনে সচেষ্ট ও দীনের বিজয়ে উন্মুখ অনেক ভাই অফলাইন দাওয়াহর প্রয়োজন বুঝেছেন ও দিচ্ছেনও। তবে উপযুক্ত ট্রেনিং বা ফরম্যাট বা কৌশল জানা না থাকায় হয় বলতে গিয়ে অসুবিধায় পড়ছেন, খেই হারাচ্ছেন কিংবা ফল বিলম্বিত হচ্ছে। একটু ঘষেমেজে নিলেই আমার অফলাইন দাওয়াহ আরও শাণিত ও গভীর হতে পারে। আমি বরাবরের মতই তাবলীগের আঙ্গিকে আলোচনা করব। আপনারা নিজ মানহাজে ফেলে চর্চা করবেন। তাবলীগে দাওয়াহ-ই ছিল আমাদের আত্মশুদ্ধির প্রধান ওজীফা। শায়খ আশরাফ আলী থানভী রহঃ বলেন,

আমি যে আমলের উপর উঠতে চাই, তার দাওয়াত দিই। ফলে সেই আমল করা আমার সহজ হয়। আবার যে গুনাহ আমি ছাড়তে চাই, তার খারাবির দাওয়াত দিই, ফলে তা ছাড়া আমার সহজ হয়।

এজন্য তবলীগে দাওয়াহ দেয়া শেখানো, হাতেকলমে শেখানো ও চর্চা করানো হয়, কৌশল শেখানো হয়, কাকে কীভাবে এপ্রোচ করা হবে তার রাফ আইডিয়া দেয়া হয়। তাবলীগের বাইরে নানান মানহাজে অফলাইন ম্যান-টু-ম্যান মেহনত করছি যে ভাইয়েরা, তাদের উপকারার্থে আজকের নোট।  

লাস্ট ইজতিমার বয়ান থেকে-

দাওয়াহর মূলসূত্র হলো, আযান। আযানের দুআয় নবীজী সা. আযানকে বলেছেন ‘দাওয়াতুত তাম্মাহ’ বা পরিপূর্ণ দাওয়াত। এজন্য আমাদের দাওয়াহর ফরম্যাট আমরা আযান থেকে নিব।

১.

প্রথমে বলে নিব আল্লাহর বড়ত্ব (আল্লাহু আকবার), শক্তি, ক্ষমতা, রাজত্বের সর্বব্যাপিতা।

” হে কম্বলাবৃত, উঠুন, সতর্ক করুন, আপনার রবের বড়ত্ব বয়ান করুন।”    (সূরা মুদ্দাছছিরঃ ১-৩)

আল্লাহ কত বড়, আল্লাহ যদি চান আমার কতখানি কল্যাণ করতে পারেন, আর যদি চান আমার কতবড় ক্ষতি করতে পারেন। তিনি সৃষ্টি করতে চাইলে কল্যাণ করতে চাইলে কোন ম্যাটেরিয়াল লাগে না। তিনি ইচ্ছা করলেই সব হয়ে যায়, কুন ফাইয়াকুন। যেখানে আমি কোন সমাধান দেখি না, সেখানে আল্লাহ গায়েব থেকে আমার সমস্যার সমাধান করতে পারেন। নবী আলাইহিস সালামগণের ঘটনা উদাহরণ হিসেবে আনা যেতে পারে। ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে আপন পিতাও (মতান্তরে চাচা) পোড়াতে চেয়েছেন, রাষ্ট্র-পরিবার-সমাজ সবাই বিরুদ্ধে, আগুনে ফেলাও হয়েছে। সেই আগুনকেই আল্লাহ তাঁর ইজ্জত ও আরামের কারণ বানিয়েছেন। 

২.

আল্লাহর একত্ব ও এককত্ব। (আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) আল্লাহ একাই ছিলেন, পরেও একাই থাকবেন। একাই ইবাদতের যোগ্য। পালেন একা, খাওয়ান একা, সৃষ্টি করেন একা, সুস্থ্য করেন একা।

“বলুন, হে আল্লাহ,হে সমস্ত রাজ্যর মালিক, আপনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দেন, যার কাছ থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নেন। যাকে ইচ্ছা ইজ্জত দান করেন, যাকে ইচ্ছা বেইজ্জত করেন। কল্যাণ আপনার হাতেই, নিশ্চয়ই আপনি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান”। ( সূরা আলে ইমরানঃ ২৭)

এগুলো করার জন্য তিনি কোন বস্তু-মাধ্যম-সত্তার মুখাপেক্ষী নন। এজন্য তোষামোদ-খোশামোদ যদি কারো করতেই হয় তো সে আল্লাহ। ২৪ ঘণ্টা আমার সকল প্রচেষ্টা যদি কেউ পাবার হকদার হয়, তো তিনি আল্লাহ। হযরতজী ইনআমুল হাসান কান্ধলভী রহ. ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর ব্যাখ্যায় বলতেন, ‘জী লাগানে কি লায়েক আল্লাহ ছাড়া কোয়ি নেহি’। মন-প্রাণ-অন্তর কাউকে/ কোন ব্যস্ততাকে যদি দিতেই হয়, সে আল্লাহ। দিল লাগানোর উপযুক্ত একমাত্র আল্লাহ। মানুষের ভালমন্দ কীসে তা জানেন একমাত্র আল্লাহ। তাই আইনদাতাও একমাত্র তিনিই, তাঁর আইনেই মানবজাতির কল্যাণ। সত্তায় ও গুণাবলীতে তিনি একা।  

৩.

এরপর বলব যে, মুহাম্মদ সা. সেই একক আল্লাহর পাঠানো ব্যক্তি, রাসূল (আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ)। তাঁকে দিয়ে আল্লাহ দীন পাঠিয়েছেন আমাদের কাছে। দীন হল, একক আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য লাইফস্টাইল বা সিস্টেম। যাই আমরা করি এই অনুমোদিত সিস্টেমে না করলে সেই একক আল্লাহ মেনে নেবেন না আমাকে।এজন্য রাসূল মুহাম্মদ সা. এর সিস্টেমে (পন্থায়) ব্যক্তিজীবনে সুখ, পারিবারিক জীবনে শান্তি, সামাজিক জীবনে নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমাধান, পরকালীন জীবনে মহাসফলতা। আর এই স্পেসিফিক সিস্টেমটা ছাড়া আর যত সিস্টেম আছে (পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ব্লা ব্লা), সব সিস্টেমে ব্যক্তিজীবনে অসুখ, পারিবারিক জীবনে অশান্তি, সামাজিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতা, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমস্যা, পরকালীন জীবনে মহাধ্বংস।

“যে আমার কথা মানিল এবং আমার আনীত দ্বীনের অনুসরণ করিল সে বাঁচিয়া গেল।আর যে আমার কথা মানিল না এবং আমার আনীত দ্বীনকে মিথ্যা সাব্যস্ত করিল সে ধ্বংস হইয়া গেল। ” (বুখারীঃ৭২৮৩)

৪.

এরপর তাকে যে আমলের দাওয়াহ দিতে চাই, সেটা (হাইয়া আলাস সলাহ)। নামায হতে পারে, রোজা হতে পারে, মসজিদের নির্মাণে সদকা হতে পারে, মুহাজিরীনদের জন্য মাল জমা হতে পারে, তালিম-তাফসীরের হালাকার জন্য হতে পারে।

৫.

কেন এই আমলটা তার করা দরকার, কী লাভ, কী পাবে করলে (হাইয়া আলাল ফালাহ)। আর না করলে কী ক্ষতি। ইহলোক-পরলোকে কি সমস্যা। এ অংশে সরাসরি হাদিসে বর্ণিত লাভ-ধমকি উদ্ধৃত করা চাই। এজন্যই ফাজায়েল (ফজীলত) সংক্রান্ত হাদিসগুলো দাঈদের মুখস্ত থাকা দরকার। এক তো দাওয়াতের কাজের জন্য। আর দুই, মাসায়েল একবার শিখলাম তো শেখা হয়ে গেল। কিন্তু ফাজায়েল প্রতিদিন শুনলে ঈমান বাড়ে। মানুষ ভুলে যায়, প্রতিদিন একটু একটু শোনার/ পড়ার অভ্যাস করলে আমলের প্রতি আগ্রহ বজায় থাকে। এজন্য প্রতিদিন ফাজায়েল সংক্রান্ত হাদিস হালাকা আকারে শোনার সাথে ঈমান বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। মুন্তাখাব হাদিস, আদাবুল মুফরাদ, রিয়াদুস সলিহীন বা আলিমগণের পরামর্শ মোতাবেক অন্য কোন কিতাব বেছে নিলে দাওয়াতের যোগ্যতার সাথে সাথে ঈমানের ক্ষয়পূরণও হতে থাকবে।

তাবলীগে দাওয়াতের কথাগুলোর একটা ফরম্যাট আমরা শিখেছিলাম। এই ফরম্যাটে ফেলে ১ মিনিটও দাওয়াত দেয়া যায়, ৫ মিনিটেও দিতে পারবেন, আবার সুযোগ থাকলে বসে ৩০ মিনিট কথাও বলতে পারবেন, ১ ঘণ্টা বয়ানও করা যাবে ছোট কোন জমায়েতে।

১. সালাম ও মুসাফাহা:

সালাম মাদ’উ (যাকে দাওয়াহ দেয়া হচ্ছে) ব্যক্তির মনে আপনার ভালোবাসা তৈরি করবে। (হাদিস) এবং এই ভালোবাসা পরিপূর্ণতা পাবে মুসাফাহায়।

তবে হাত নিয়ে নিজের হাতের ভিতর রেখে দিলে অনেকে বিরক্ত হন। তাই এটা অনুচিত। এরপর সময় ও পূর্বপরিচয় সাপেক্ষে কুশলাদি বিনিময় হতে পারে।

২. আল্লাহর নিআমত স্মরণ করিয়ে দেয়া:

” এবং আপনার রবের নিআমতের কথা ঘোষণা করুন/ আলোচনা করুন”     ( সূরা দোহাঃ১১)

কেউ যখন দুনিয়ার আলোচনা করে তখন আমরা কান লাগিয়ে শুনি, আর আখিরাত বা আল্লাহর আলোচনা উঠলে উদাসীনতার সাথে শুনি। নিজেকে দিয়েই টেস্ট করতে পারেন। যে মুহূর্তে আল্লাহর প্রসঙ্গ উঠবে ঐ মুহূর্তে মনোযোগ কমে যাবে, আগে যে মনোসংযোগটুকু আপনার এমনিতেই ছিল এখন সেটুকুও জোর করে রাখতে হচ্ছে। এটা শয়তানের পক্ষ থেকে। এজন্য দাওয়াহর শুরুতে তাকে আল্লাহর নিআমত ও গুরুত্বের কথা শোনাতে হবে। তুমি যে এই মুহূর্তে সুস্থ, এটা আল্লাহ আমাদেরকে রেখেছেন। কত মানুষ হাসপাতালে, আমি তুমিও থাকতে পারতাম। আল্লাহ রাখলে আমাদের আটকানোর ক্ষমতা ছিল না। এই যে দোকান-ব্যবসা করছো এটা তো আল্লাহই দিয়েছেন। এই যে জীবন, এই যে ২৪ ঘণ্টা, কে দিলেন? এই যে আলো-বাতাস-অক্সিজেন, কার দেয়া? এই আমরা মুসলিম, কাফির বানালে কী করার ছিল, অনন্ত আগুনে জ্বলতাম, এই ঈমানের নিআমত বা চাইতেই কে দিলেন? এইবার ফণা নুয়ে আসবে। কান লাগাবে বাকি কথায়। আল্লাহর গুরুত্ব স্মরণে এসেছে এবার। এবার কান লাগিয়ে শুনবে।

৩. কালিমা:

দাওয়াহ যেকোন এক পর্যায়ে বা মওকায় স্পষ্ট সহীহ উচ্চারণে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ নিজে পড়ে সাথে সাথে তাকেও পড়তে উৎসাহিত করা। অর্থও তার মুখে বলানো- আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর কেউ নেই, মুহাম্মদ সা. সেই আল্লাহর রাসূল।

কালিমাওয়ালা জাহান্নামে অজানাকাল পুড়ে হলেও একদিন জান্নাতে প্রবেশ করবে ইনশাআল্লাহ।  এটাই আহলুস সুন্নাহর আকীদা। আল্লাহ চাহেন তো, আজকের এই কালিমার স্পষ্ট সত্যায়ন হাশরের মাঠে তার কাজেও আসতে পারে।

৪. তাওহীদ: আগের আলোচনার ২ নং পয়েন্ট।

৫. রিসালাত: আগের আলোচনার ১ নং পয়েন্ট

৬. আখিরাত:

এরপর দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্ব-নগণ্যতা-ধোঁকা এবং আখিরাতের চিরস্থায়িত্ব-আসল জীবন-সুখের অসীমতা আলোচনায় আসবে। এখানে আমরা মুসাফির, ওখানটা আমাদের আসল ঠিকানা, আসল গন্তব্য। কবরে কী কী হবে, হাশরের মাঠে কী কী হবে, সীরাতের পুলে-জান্নাতে-জাহান্নামে কী কী আছে। সময় অনুপাতে সংক্ষিপ্ত বা বিশদ আলোচনায় আসবে।

“হে আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, হে হিন্দ বিনতে ওতবাহ, খোদার কসম তোমরা একদিন অবশ্যই মৃত্যুবরণ করিবে। তারপর পুনরায় তোমাদিগকে জীবিত করা হইবে।অতঃপর নেককার বেহেশতে এবং বদকার দোযখে যাইবে।আল্লাহর আযাব সম্পর্কে তোমাদেরকেই সর্বপ্রথম সাবধান করা হইল।”         বর্ণনাকারী মুআবিয়া রাঃ (কানয)

৭. নিয়ত করানো:

দাওয়াহ দিয়ে ফেলে রেখে আসলে রেজাল্ট আসবে না। বিষয়টা এমন হলো, তাকে ময়লা থেকে তুলে ধুয়ে আবার ময়লাতে ফেলে এলেন। সম্ভব হলে সাথে করে মসজিদে আনা যদি পরের ওয়াক্ত নিকটবর্তী থাকে। নয়তো তাকে কোন একটা ঈমানবান্ধব পরিবেশে আসার জন্য নিয়ত করানো। সেটা প্রতি ওয়াক্তে মসজিদে আসা হতে পারে, তালিমের হালাকা, কোন তাফসীরের হালাকা, কোনো শায়খের মজলিস। আমরা শুনি, খুব উপকার পাই, আপনিও থাকার নিয়ত করেন ইনশাআল্লাহ।  (হাদিস) নিয়ত মানে ওয়াদা না, শয়তান এখানে একটা খেলা খেলে। আমাদেরকে ভাল কাজের নিয়তই করতে দেয় না। নিয়ত করার পর না তৌফিক মিলবে।

ধরেন সে এলো না, আবার একদিন গেলেন, দাওয়াহ দিলেন, পরিবেশে আসার কথা বললেন, আবারও এলো না। একদিন তার মনে হবে, ওরা বার বার আসে, আমি একবারও যেতে পারি না, এবার যাবোই। শুরুতে বিয়ের দাওয়াত নিয়ে একটা উদাহরণ দিয়েছিলাম। একবার পরিবেশে এলে অন্তরের যে পরিবর্তন, তা পূর্বের পরিবেশে ৫০ বার দাওয়াহ দিলেও ঐ পরিবর্তন আনা কঠিন। এজন্য পরিবেশে আনার জন্য চেষ্টা করা, তবলীগের ভাষায় বলে তাশকীল। এটা ছাড়া দাওয়াহটা পরিপূর্ণতা পেল না। তাকে দীনে আনার জন্য আপনার প্রচেষ্টাটা এর দ্বারা পূর্ণ হলো। তবে জোরাজুরি না করা, বার বার গিয়ে তার নিজের ভেতর থেকে অপরাধবোধ, দায়িত্ববোধ জাগানোটা উদ্দেশ্য। আজকেই আনতে হবে, এনেই ছাড়ব, এমন না ব্যাপারটা।

এটা একটা রাফ ফরমেট। ৭ টা পয়েন্ট টাচ করে আপনি ৭ মিনিটে দাওয়াহ শেষ করতে পারেন। আবার আধা মিনিট করে সাড়ে তিন মিনিটেও শেষ করতে পারেন। রিকশাওয়ালা-দোকানদার বেশি সময় আপনাকে দেবে না। তাকে ৩.৫-৭ মিনিটে এই ফরমেটে দাওয়াহ দিতে পারেন, পরিচিত বন্ধুকে ১৫/২০ মিনিট নাসীহা করতে পারেন।  

মহল্লায় আমরা তাবলীগী ফরমেটে ২ ধরনের ওয়ার্ক করি। একটা র‍্যান্ডম দাওয়াহ, সবাইকে গণহারে, সামনে যাকে পাব তাকেই। নিজের ঈমান বাড়ানোর জন্য। আরেকটা টার্গেটেড দাওয়াহ, দীর্ঘমেয়াদী। টার্গেট করে করে। উনি ফাঁকা আছেন, সামনে সরকারি ছুটি আছে, হয়তো ৩ দিনের জন্য আমাদের সাথে ঈমানবান্ধব পরিবেশে যেতেও পারেন। এরকম টার্গেটেড দাওয়াহতে আরও দুটো-তিনটে কৌশল আছে।  

১. যাকে আপনি দীনের পথে আনতে চান তাকে হাদিয়া দিন। সুন্নাহ জিন্দা করা। সম্পর্ক গভীর করে দাওয়াহ পেশ করা।

২. মেহমানদারি করে সম্পর্ক তৈরি করা। খানা খাওয়ানো। এরপর দাওয়াহ পেশ করা। একজন মজা করে বলেছিল, enter into his heart through his stomach. হা হা। অবশ্যই আল্লাহর জন্য। তাকে আল্লাহমুখী করার জন্যই তো এতোকিছু। 

৩. তার নাম ধরে দুআ ও নফল আমল করা। মওলানা তারিক জামিল হাফিযাহুল্লাহ পপস্টার জুনায়েদ জামশেদের (রাহিমাহুল্লাহ) জন্য ৫০ রাকাত নফল নামায পড়েছিলেন। মেডিকেল-বুয়েট-ভার্সিটিতে তবলীগওয়ালাদের মধ্যে এটা খুব কমন প্র্যাকটিস। জুনিয়র ছেলেদের জন্য নফল রোযা, সাদাকা, তাহাজ্জুদে নাম ধরে দুআ। ভাগ ভাগ করেও নেয় অনেক সময়। আমার মহল্লায় বাবর ভাই নফল সাওম রেখে দাওয়াতে বের হতেন। তিন দিনের জামাতেও তিনদিনই রোযা রেখে দাওয়াহ দিতেন। আপনারাও প্রিয়জনকে দাওয়াহ করারা ক্ষেত্রে কৌশলটা কাজে লাগাতে পারেন। হিদায়াত তো আল্লাহই দিবেন, আমরা কেবল বাহানা বানাবো, তাই না?

আমার বন্ধু ইমরান বলছিল সেদিন। দোস্ত, প্রত্যেকটা মানুষের দিকে তাকা, দেখ প্রতিটা মানুষ জ্বলছে ভিতরে ভিতরে। প্রত্যেকের ভিতরে একটা জ্বালা, একটা কষ্ট। ঠিক তাই, আজ ইসলাম ছেড়েও দিয়ে প্রতিটা মানুষ মহাসমস্যায় মহামুশকিলে পড়ে গেছে। মুসিবত থেকে বাঁচার জন্য ইসলাম থেকে আরও দূরের পথ বেছে নিচ্ছে। রিজিকের সমস্যা? সুদ নিয়ে ব্যবসা কর তাহলে। এবং আবশ্যিকভাবে আরও সমস্যায় পরে যাচ্ছে। আমরা যারা দীন বুঝেছি কিছুটা, এখন আমাদের কাজ অনেক, দায়িত্ব ম্যালা। এক এক বেখেয়াল লোকের কাছে গিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বুঝাতে হবে, শোনেন ভাই, আপনার সমস্যার সমাধান তো ইসলামে। সে শুনতে চাবে না, তবুও শোনাতে হবে। সে রাগ হবে, তাড়িয়ে দেবে, কটূকথা বলবে। তারপরও তাকে বুঝাতে হবে। কেননা সে মহাবিপদে আছে দুনিয়ায়, মৃত্যুর পর মহামহামহাবিপদে পড়ে যাবে। এক হাদিসে নবীজী বলেন কমবেশি এমনঃ

আমার আর তোমাদের উদাহরণ এরকম, যেমন আগুনে ঝাঁপ দিতে উদ্যত পোকামাকড়। তোমরা সকলে ঝাঁপ দিয়ে আগুনে গিয়ে পড়ছো, আর আমি কোমড় ধরে তোমাদের এক এক জনকে বাঁচাচ্ছি। 

আমাদেরও একই কাজ। এটাকে উম্মতের দরদ বলে। আহা রে, আমার নবীর উম্মত। তাঁর উম্মত জাহান্নামে যাচ্ছিল, আর আমি তাঁর মহব্বতের উম্মতের জন্য কিছুই করলাম না, তাঁকে মুখ দেখাবো কী করে।

তো লেগে যাই আজ থেকেই। আল্লাহ আমাদের ভাঙাচুরা বাহানাগুলোকে কবুল করে আমার ও পুরো উম্মতের হিদায়াতের ফায়সালা করে দিন। আমীন।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *