SHAMSUL AREFIN SHAKTI·MONDAY, FEBRUARY 11, 2019
ভাবার জন্য পইড়েন। আমারে দুটা গালি দিলে তো দেয়াই যায়, ওতে ফায়দা নেই। আমাকে আনফলো- আনফ্রেন্ড করে দেন।
এসব লিখতে চাইনি। তবু লিখতে হচ্ছে। ফেসবুকে অনেক বিপুল সংখ্যক মানুষ ‘কাদিয়ানীরা’ কাফির কি না— এটা নিয়ে সংশয়ে পড়ে গেছে। অনেকে ফিকহী মতপার্থক্য মনে করছে, কেউ আবার আকীদার ‘ব্যাখ্যা’ লেভেলের সূক্ষ্ম মতপার্থক্য মনে করছে। এজন্য লিখছি। কারও পছন্দ হবে, কারও হবে না। ফেসবুকে রাজনীতি করতে আসিনি যে, আমার পিছনে বিপুল জনসমর্থন লাগবে। বই আল্লাহ লিখিয়েছেন, তার মধ্যে হেদায়েতের কিছু থাকলে আল্লাহই পৌঁছে দিবেন। আমাকে পছন্দ না হলে আমার বই পড়ার জন্য আপনি বাধ্য না।
তখন কেবল ৩ চিল্লা শেষ করে এসেছি। রক্ত আগুন হয়ে আছে। সব পরিবর্তন করে ফেলব, সব ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলব। দীনের জন্য সর্বোচ্চ কুরবানি দিয়ে দেব। আলিমদের জন্য দিল দিওয়ানা। ধারে কাছে যেখানে তাফসীর হচ্ছে, মাহফিল হচ্ছে, ডিউটির ফাঁক পেলেই দৌড়। পারলে দু’চারজনকে সাথে নিয়ে। ইজতিমার মাঠে বর্তমানে ‘গোমরাহ’ এক আলিমের মুখে যখনই শুনলাম ‘উলামায়ে কিরামের মজলিসে বসাকে গণিমত (সম্পদ) মনে কোরো, উলামায়ে কিরামের যিয়ারতকে ইবাদাত মনে কোরো’। আর পায় কে? সোহরাওয়ার্দীর ধারে কাছে যত আলিমদের মাহফিল, প্রায় সবগুলোতে থাকার চেষ্টা করতাম, তবে অবশ্যই দেওবন্দী কওমী আলিমদের। যেহেতু বাকিরা আলিম না, ভ্রান্ত।
তাবলীগের নিয়ম ছিল, চিল্লার ভিতর কোনো মতবিরোধপূর্ণ মাসয়ালা আলোচনা হবে না। সেই হিসেবে এসব আলোচনাই ছিল না। শায়খ যাকারিয়া রহ: লিখেছিলেন, ‘তাবলীগ হল আমলের পিপাসা তৈরি করে দিবে। এরপর আহলে হাদিসরা যাবে আহলে হাদিস আলিমের কাছে পিপাসা মিটাতে, হানাফীরা হানাফী আলিমের কাছে গিয়ে মিটাবে, শাফেঈরা শাফেঈ আলিমের কাছে’। তাবলীগ থেকে এসে যখন ওলামাদের মাহফিলে যাওয়া শুরু হল, তখন চিনলাম জাকির নায়েক গোমরাহ, ইহুদিদের দালাল। আব্বুর সাথে কতবার জাকির নায়েককে নিয়ে তর্ক করেছি, আহলে হাদিসরা যে আসলেই ইহুদিদের এজেন্ট প্রমাণ করতে চেয়েছি। আব্বু পীসটিভি দেখতেন, সেটা বন্ধ করার জন্য কত ঝগড়া করেছি। এগুলোর কোনোটাই তাবলীগ আমাকে শেখায়নি।
হোস্টেলে আহলে হাদিসের ছেলেরা বাইরের এক আলিমকে নিয়ে এসে আরবি শিখবে, অনুমতি দিইনি। হোস্টেল থেকে বের করে দেবার ভয় দেখিয়েছি। তাবলীগের কোনো ছেলেকে ওরা যেন ওদের সাথে না নেয়, কড়া করে বলে দিয়েছি। ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের মাহফিলে ইয়ামিনের সাথে তাবলীগের এক ছেলে যেত। তাই ঐ ছেলেটাকে যে কি না তাবলীগের জন্য বরাদ্দ রুমে থাকত, তাকে রুম থেকে বের করে দিতে চেয়েছি। কারণ ওরা বিভ্রান্ত, ইহুদীদের দালাল। আমার প্রিয় আলিমগণ বলেছেন। আমার প্রিয় আলিম তখন শায়খুত তাফসির ওলিপুরি হাফিজাহুল্লাহ। অবাক জীবন্ত বিস্ময় আমার কাছে উনি। আহলে হাদিসদের বিরুদ্ধে যত দলিলাদি সব সংগ্রহ করে ফেলেছি। নিয়মিত হোস্টেলে তর্ক বিতর্ক করছি।
একবার কাকরাইলে ডা. রফিক স্যারের সাথে পরামর্শ করলাম গিয়ে, স্যার, আমাদের হোস্টেলে আমরা মেহনত করে করে যে ছেলেগুলোকে দীনের উপর উঠাই, আহলে হাদিসরা সেগুলোকে মেহনত থেকে সরিয়ে আহলে হাদিস বানিয়ে ফেলে। কী করব? বের করে দেব? স্যার জানালেন, তোমরা হকের মেহনত করতে থাকো। আল্লাহ চাইলে তারাও তোমাদের সাথে দাওয়াতে অংশ নেবে। এরপর আমরা শান্ত হলাম। ঠিকই আমাদের আহলে হাদিস ছোটভাই ইয়ামিন ফাইনালের পর ২৮ দিন সময় দিয়ে এলো চিল্লায়। এমন শত্রুভাবাপন্ন আমাকে তাবলীগ বানায়নি। কিন্তু তারপরও আমি ডা. জাকিরকে ইহুদীদের দালালই ভাবতাম, যদিও তাঁর ৮০% ইংরেজি লেকচার আমার তাবলীগের আগেই শোনা। সালাফীদেরকে ইহুদীদের দালাল ভাবতাম। এতো পরিমাণে শুনেছি। অবশ্য আহলে হাদিস আলিমরাও প্রথমদিকে মাজহাব ও আবু হানিফাকে নিয়ে যা শুরু করেছিল তাতে দেওবন্দী আলিমদেরও দোষারোপ কেউ করতে পারবে না, যদিও এখন অনেকটাই শান্ত পরিস্থিত।
এরপর আরও বইপত্র পড়া শুরু করলাম। হাতের কাছে যা পেলাম। বুঝলাম, আহলে হাদিসরা আসলে অনুসরণ করে সৌদি সালাফী আলিমদের। এবং তারা যা করে এবং যে আকীদা আল্লাহর ব্যাপারে রাখে, সেটাও ইসলামেরই আরেকটা মত। এতদিন ইসলাম বলে যেটুকু জেনেছি, ইসলাম এর চেয়ে বিশাল। তারা ইহুদীদের দালাল না, বরং তারাও মুসলিম আমারই মত। এতদিন নামায যেভাবে পড়েছি, এটা সহীহ। সেই সাথে আরও অনেকরকম নামায পড়া যায়, সেগুলোও সহীহ। তাদের আমলগুলো নিয়ে হাসাহাসি করেছি, এগুলোও ইসলামের আলিমগণেরই আরেকটা মত, গোমরাহী না, আহলুস সুন্নাহ থেকে বাইরে না। তাহলে এতদিন কী শুনলাম, কী জানলাম?
জামাআতে ইসলামীকে পুরোপুরি ভ্রান্ত জেনেছি। জামাতী কারো সাথে মেয়ে বিয়ে দেয়া যাবে না। জামাতী ইমামের পিছে নামায পড়তামনা। শিবিরের যে দু’একটা ছেলে হোস্টেলে থাকত ছদ্মবেশে তর্কে লিপ্ত হতাম। ছাত্রলীগ আগেই হোস্টেল থেকে শিবির বের করে দিয়েছিল। কিছু ছেলেকে তাবলীগের শেল্টারে হলে রাখতে পারতাম, করিনি। ওরা ভ্রান্ত মওদূদীর অনুসারী। তাফহীমুল কুরআনের এক পারা বাসা থেকে সরিয়ে ফেলেছিলাম। মওদূদী আলিম না, গোমরাহ, সাহাবাবিদ্বেষী, নবীবিদ্বেষী। এখন পড়েশুনে দেখি, ঘটনা তো যেমন শুনেছি তেমন তো না। তাঁর ইলমের সনদও আছে, এক মাদ্রাসা থেকে না, ভিন্ন ভিন্ন উস্তাদের কাছে। নবীদের সম্পর্কে তিনি সগীরা গুনাহ-সহই তাঁদেরকে নিষ্পাপ মনে করতেন। এটাও একটা মত যে, নবীরা মাঝে মাঝে সগীরা গুনাহ বা সিদ্ধান্তগত ভুল করেছেন (তাঁরা ফেরেশতাদের মত নির্ভুল নন), আল্লাহ তাঁদের সেইটুকু মাফ করে দিয়েছেন, এগুলো সহই তাঁরা মাসুম। তাহলে এই আকীদার জন্য তিনি গোমরাহ হবেন কেন? এটা তো আহলুস সুন্নাহরই আরেকটা আকীদা। মুয়াবিয়া রা. এর শানে বেয়াদবির জন্য তিনি গোমরাহ? রাজতন্ত্র তো ইসলামে জায়েয, যেমন আমরা পরবর্তী খলিফাদের ক্ষেত্রে দেখেছি। তিনি ইজতেহাদী ভাবে নিজ ছেলেকে মনোনীত করেছে। তিনি তো নাজায়েয কোন কাজ করেননি। আর শিক্ষার নির্যাস গ্রহণের জন্য সাহাবাদের কর্মপদ্ধতি নেগেতিভ-পজেটিভ আলোচনা করার কি অনুমতি নেই? ইজতেহাদী ভুল সহই সাহাবারা উম্মাহর আদলের মাপকাঠি। এটা বিশ্বাস করার জন্য কেউ গোমরাহ, তাদের পিছনে নামায হবে না? তাহলে এতদিন ওয়াজ-মাহফিলে কী শুনলাম, আর এখন কী পড়ছি?
এখন ওয়াজ মাহফিলে আরেকজনের নাম খুব উঠে আসছে। আমি একজন জাহেল হিসেবে, মূর্খ হিসেবে হাতের কাছে যা যা পেয়েছি, প্রত্যেকটাতে ওনাদের অভিযোগ অসত্য পাচ্ছি। আপনাদের যাদের যাচাইয়ের যতটুকু ক্ষমতা আছে, আপনারা যাচাই করুন। বাংলায় অনূদিত ইসলামিক ফাউন্ডেশানের আসহাবে কাহাফের ইতিবৃত্ত বইয়ে আমি পেয়েছি। মাআরেফুল কুরআনে আমি পেয়েছি। যতটুকু বাংলায় অনুবাদ হয়েছে, ততটুকু তো দেখুন। হতে পারে সেই ব্যক্তি এদেশে প্রচলিত ব্যাখ্যা রেখে ভিন্ন কোন ব্যাখ্যার কথা বলছে। কিন্তু সেটাও তো আহলুস সুন্নাহরই আরেকটা মত। এজন্য তো তাকে গোমরাহ আর ইহুদীদের দালাল বলা যায় না। একই অপবাদ, একই লুকোছাপা। যে কেউ ওনাদের কথা শুনে নিজের সাধ্যমত যাচাই করতে গেলেই বুঝে যাবেন, কীভাবে একমাত্র নিজের মতকেই ইসলাম বলে দাবি করে ইসলামেরই আর সব মত আর সব ব্যাখ্যাকে আহলুস সুন্নাহ থেকে বের করে দেয়ার এক প্রবণতা।
শত শত মাহফিলে শুনেছি, মিলাদ বিদআত। কিন্তু খলীল সাহারানপুরী রহঃ এর দেওবন্দী আকীদার মাস্টারপিস ‘আল-মুহান্নাদ’-এ আমি নিজে দেখলাম, মওলুদ শরিফ (নবীজীর জন্মবৃত্তান্ত পাঠ) সওয়াবের কাজ। বেরেলভীদের নূর সম্পর্কিত আরও আকীদা বাজে আছে। কিন্তু তারপরও তো আহলুস সুন্নাহর বাইরে না। এ কেমন এক গোমরাহ গোমরাহ খেলা? আমার মত তো আরও তরুণ আছে যারা দুই দিকের ইনফরমেশান তুলনা করে এমন কনফিউজ হয়ে গেছে। এখন এতোদিন পর আবার উঠে এসেছে কাদিয়ানি ইস্যু, কেউ কেউ যদি এই ব্যাপারে ওনাদের উপর আস্থা রাখতে না পারে, সে দায় কাদের বলুন। একটা সময় তো কাদিয়ানিরা যে কাফির, এ ব্যাপারে কোন সংশয়ই ছিল না। এখন আহলে হাদিস, জামাতী বা সাদপন্থীরা যদি ভাবে যেরকম তাদের আদর্শের সাথে করা হয়েছে, কাদিয়ানিদের সাথেও তা-ই করা হচ্ছে কি না। তখন কী করণীয়। আস্থা আর আগের মত নেই, তাই কী?
কাউকে দোষারোপ না, সে যোগ্যতা নেই। একটা মনস্তত্ব বিশ্লেষণ করলাম, নিজের প্রেক্ষিতে। জাকির নায়েক, সাইয়েদ মওদূদি আর মাওলানা সাদ— এনাদেরকে পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী চিন্তাধারা ভ্রান্ত মনে করে। পৃথিবীর আরও বহু আহলুস সুন্নাহ চিন্তাধারা তাদের গোমরাহ মনে করে না। সুতরাং আমিও তাদের ভ্রান্ত মনে করি না। তবে কাদিয়ানি ইস্যুটা ভিন্ন। সারা দুনিয়ার বিভিন্ন চিন্তাধারার ইজমায় (সর্বসম্মতিক্রমে) কাদিয়ানিরা কাফির। যারা কনফিউশানে আছেন, ক্লিয়ার হয়ে নেন। অন্যান্যগুলোর মতো এটা না। সুতরাং ইসলামের নামে মানুষকে কাফির বানানোর এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা শুধু দেওবন্দী উলামায়ে কিরামের দায়িত্ব নয়। আহলে হাদিস, বেরেলভী, জামাআতে ইসলামী, সাদপন্থী সহ প্রত্যেকের উম্মাত হিসেবে দায়িত্ব এদের প্রতিহত করা, যার যার অবস্থানে। আমাদের নবী তো একজনই, তাঁর কাছে কী জবাব দিবেন বলেন?
https://islamqa.info/en/answers/4060/qadianiyyah-in-the-light-of-islam [সালিহ আল-মুনাজ্জিদ]
http://www.khatmenubuwwat.org/media/File/fatawas/fatwa_al_azhar.pdf [আল-আযহার]
http://alhafeez.org/rashid/rabita.html [রাবেতার সমন্বিত ফতোয়া]