SHAMSUL AREFIN SHAKTI·THURSDAY, OCTOBER 11, 2018
– ‘আচ্ছা তোরা রাজনীতি করতে চাস কেন? একজন একজন করে বল’।
– ‘ভাই, আমি ইঁদুরের মত বাঁচতে চাই না’।
হিদায়াত, পথের খোঁজ। কোন পথ? কেমন সে পথ? পিচঢালা, না মেঠো, না ডিজিটাল? সে পথ বড় সহজ, বড় আরাম। ছোটবেলা থেকে আমাদের মাথায় পুঁজিবাদী, ‘স্বল্পমূল্যে শ্রমসন্ধানী’ সিস্টেম একটা কথা শিখিয়ে দিয়েছে— লাইফ ইজ নট অ্যা বেড অব রোজেজ। জীবনটা ফুলের বিছানা নয়। জীবন খুব কঠিন, টিকে থাকার জন্য প্রতিযোগিতা করতে হবে। বস্তুবাদী সমাজে বস্তু কেনার যোগ্যতা চাই, নাহলে কমফোর্ট জোনে থাকতে পারবা না । লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে। গাড়ি-বাড়ি-নারী-কাঁড়িকাঁড়ি কড়ি-ছড়ি এগুলোর জন্য দৌড়াও, ভাগো।
আরেকটা পথ আছে, কমফোর্ট জোনে ঢোকার পথ, আরাম-শান্তি-সুখের পথ। কমফোর্টের জন্য যে পথে উন্নত বস্তু লাগে না, কুঁড়েঘরেই-অর্ধাহারেই-হাঁটাপায়েই সেখানে কমফোর্ট মেলে। অর্জনের প্রতিযোগিতা নেই সেপথে। শুধু আছে বিসর্জনের প্রতিযোগিতা। ‘বস্তু ভোগের মাঝে তৃপ্তি’ আগের ওই পথে। আর এই পথে –‘ভোগে নয়, ত্যাগেই সুখ’, আসল সুখ।
এই পথের সন্ধান পাওয়াকেই বলছি হিদায়াত, যে পথের দুধারে ফুলের মত ফুটে থাকে সুখেরা। আমি কোন কিতাবী নীতিবাক্য বা কম্যুনিজমীয় ইউটোপিয়া বা ঠাকুরমার ঝুলির কথা বলছি না। রেগুলার শেভের আড়ালে পাকা দাড়ির গোড়ার মত বাস্তব, কড়া মেকআপের আড়ালে প্রৌঢ়ার ভাঁজ পড়া চামড়ার মত বাস্তব এক পথের অস্তিত্ব জানাচ্ছি আপনাদেরকে, যেখানে সুখের অভিনয় করে প্রতি মুহূর্তে মরতে হয় না। সে রাস্তায় ‘দম নিলেও’ ঘ্রাণ পাওয়া যায় সুখের, এতটাই সস্তা সেখানে সুখ। একটা ছেলের গল্প শোনাবো আজ।
‘ছেলেটি’র জগতটাও টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত-সন্তানের জীবন দর্শনে ঠাসা। পুঁজিবাদের সেবা করে নিজের কমফোর্ট জোন নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য ‘পুঁজিবাদের ঠিক করে দেয়া শিক্ষাটা’ ভালোমত আয়ত্ত্ব করাটা জরুরি। যেখানে ভালো বাবা, ভালো স্বামী, ভালো সন্তান কীভাবে হতে হয়— তা নেই। ভালো চাকর হয়ে কীভাবে ভালো চাকরি করা যায়, শুধু সেটা শিখলেই যথেষ্ট। এরপর বস্তু আহরণের জন্য এমনভাবে চাকরগিরি করবে, যাতে সন্তান বাপ-মাকে কাছে না পায়। বস্তুর জন্য যৌতুক চেয়ে বউ পেটাতেও না বাধে। আর, বুড়ো বাপের সম্পত্তি লিখে নিয়ে আশ্রমে পাঠিয়ে নিজের কমফোর্ট জোন নিশ্চিত করা যায়। ভালো বাবা, ভালো স্বামী, ভালো সন্তান হওয়া শেখেনি যে। শিখেছে শুধু বস্তু লাগবে নিজের কমফোর্টের জন্য— গাড়ি-বাড়ি-আইফোন-বাইক। সে জগতে বস্তুই সব, বাকি সব মিথ্যে।
তো, দক্ষ চাকর হবার জন্য ছেলেটা ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হলো। সেখানে নাকি চাকর হবার সব গুণগুলো বিকশিত হয়— মনিবের ভাষায় পটাপট কথা বলা, কো-কারিকুলার্স, সুস্থ-সবল-বেশি কর্মক্ষম চাকর তৈরি। ভালো অর্থেই বললাম। ডানপিটে ছেলেটা কঠোর নিয়মের মাঝে আবিষ্কার করে বসল এক মহাসত্য— নিয়ম ভাঙ্গার মজা। জামাআতের সাথে মাগরিবের নামায পড়াটাও একটা নিয়ম ছিল সেখানে। আল্লাহ ছেলেটাকে মাফ করুন।
আবারো ঐ নিয়মের ভয়েই আইএসএসবি-তে গ্রীনকার্ড পেয়েও গেলো না ছেলেটা। ভার্সিটি লাইফ এনজয় করতে হবে তো। ফ্রেন্ডস-আড্ডা-ঘোরাঘুরি-বিপরীত লিঙ্গের সান্নিধ্য এসব ছেড়ে আর্মিতে গিয়ে যৌবন বরবাদ করার কোন মানে হয়? শেষমেসশ স্বপ্নের ঢাবি ক্যাম্পাসে কাঙ্ক্ষিত সাবজেক্ট (জেনেটিক্স) না পেয়ে একপ্রকার হতাশ হয়েই ভর্তি হলো ঢাকার এক সরকারি কসাইখানায়। কাহিনী শুরু হচ্ছে এখন…
প্রথম ফোঁটাঃ
– ‘বাবা, এদিকে আয়, দেখে যা’
– ‘জি আব্বু, আসছি…’
– ‘এই দ্যাখ, এই লোকটা ডাক্তার। দ্যাখ কীভাবে অন্য ধর্মগ্রন্থ থেকে রেফারেন্স দেয়। একদম মুখস্থ। শোন একটু’
– ‘তাই নাকি? আচ্ছা লোক তো!’
টিভিতে দাড়িওয়ালা, কোট-টাই পরা হালকা-পাতলা গড়নের এক লোক। ‘স’ উচ্চারণে একটু সমস্যা, ‘নাম্বার ওয়ান’ বলার সময় বুড়ো আঙুল আগে তোলে। খ্রিস্টান পাদ্রী যেন আজন্ম-বোবা, হিন্দু পণ্ডিত যেন পালাতে পারলে বাঁচে। ছেলেটা মুগ্ধ হয়ে দেখে আর ভাবে— আমিও তো ডাক্তারি পড়ি, আমিও তো পারি এমন করে মানুষের হিদায়াতের উসীলা হতে।
ছেলেটা কল্পনায় স্টেজে লোকটার জায়গায় নিজেকে ভাবে। ‘নাম্বার ওয়ান’ বলার সময় বুড়ো আঙুল আগে দিয়ে। পটাপট বলে চলে বাইবেল-গীতা-ঋগবেদ-কুরআনের চ্যাপ্টার-ভার্স নাম্বার। আমাদের ছেলেটার কুরআনের অনুবাদ পড়ার আগেই ‘ইংরেজি একটা বাইবেল’ আর ‘গসপেল অব বার্নাবাস’ শেষ হয়ে গেল। ডাউনলোড হয়ে গেল বেদের সব খন্ডই, ‘আফ্রিকান ধর্মগুলোর পবিত্র শ্লোক’ আর ‘প্রাচীন চৈনিক ধর্মপুস্তক’। ‘ডেড সী স্ক্রল’ নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখত, আর সুরিয়ানী ভাষায় (আরামায়িক, ঈসা আলাইহিস সালামের নিজের ভাষা) লিখত খাতার মলাটে নিজের নাম। এভাবেই চলছিল ফার্স্ট ইয়ারের সোনালি দিনগুলো।
ভালো চাকর হবার প্রতিযোগিতা কেড়ে নিলো সব। সঅঅঅব। ভয়ংকর সব বই, হোস্টেল লাইফ আর কিন্নরী হাসিগুলো ‘আসল’ রাস্তায় ফিরিয়ে নিলো ছেলেটাকে। হঠাৎ একদিন দেখলো ভার্সিটি লাইফ যতটা হৈ-হুল্লোড় হবার কথা ছিলো, অতটা আর হচ্ছে না। মেডিকেল কলেজের টীচারদের কড়া শাসন আর প্রথম ব্যাচের হম্বিতম্বিতে সব বরবাদ হচ্ছে, কিন্ডারগার্টেন বানিয়ে ফেলেছে একদম। এভাবে তো আর চলে না। এই প্রেসার থেকে উত্তোরণের পথও পাওয়া গেল— ছাত্ররাজনীতি। সীনা টান টান করে হাঁটা। টীচার-সিনিয়র-জুনিয়রদের সমীহের দৃষ্টি, দাবি-আন্দোলনের অ্যাডভেঞ্চার। হুমমম, চেতনার ডিলারশীপ নিয়ে নিলো ছেলেটা। কেন রাজনীতিতে আসতে চাচ্ছে, বড়ভাইয়ের এই প্রশ্নের উত্তরে ছেলেটি জবাব দিয়েছিল— ‘ভাই, আমি ইঁদুরের মত বাঁচতে চাই না’।
আর চেতনার সাথে একটু এসব না হলে চলে? এসবের সাথে একটু ‘ওসব’ না হলেও ‘সেসব’ তো লাগেই। না হলে রাজনীতি জমেই না মোটে।
দ্বিতীয় ফোঁটাঃ
প্রথম ব্যাচে লেবাস-পোশাকে হুজুর একজনই। চোখে পড়তেন না তেমন। করিডোর ধরে হেঁটে যেতেন শান্তসমাহিত, মাথানিচু করে। পিঠে থাকত পুরোনো আমলের একটি ব্যাগ। কথা হয়নি কখনো। দ্বিতীয় ব্যাচে সবাই নেতা। আমাদের আলোচ্য ছেলেটার ব্যাচে পোশাকী হুজুর নেই, চতুর্থ-পঞ্চম ব্যাচেও না। ষষ্ঠ ব্যাচে হঠাৎ করে ৫টা জবরদস্ত হুজুর এসে পড়েছে। ডিলারশীপের আওতায় ‘মুরগি ধরা’ একটা দায়িত্ব। কিন্তু এই কতগুলো মুরগি, যাদের ধরা যায় না। এদের পোশাক এদেরকে রক্ষা করে দুই গ্রুপের টানাটানি থেকে, বাতিলের দৃষ্টি থেকে। পোশাকের শক্তি। কেউ একজন এদেরকে রক্ষা করছে আমাদের শ্যেনদৃষ্টি থেকে। রুমের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে আমাদের হস্তক্ষেপ ছাড়াই।
আগে ছিল একজন, এখন হল ৬ জন। এখন চোখে পড়ে বেশি, বার বার। নতুন কিসিমের মানুষ। এতদিন জানতাম মাদ্রাসার ছেলেরা দাড়ি-টুপি-পাঞ্জাবীওয়ালা। এখন দেখি মেডিকেলেও। ছেলেটার ব্যাচে আলিয়া মাদ্রাসা থেকে একটা ছেলে এসেছিল। দাড়ি আছে, শার্টপ্যান্ট পরে। কিন্তু এই হুজুরগুলোর মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডও নেই। এতদিন একটা লজিক দাঁড় করিয়েছিল ছেলেটা। আল্লাহ জিগ্যেস করলে বলবে— ‘মালিক, আপনি আমাকে মাদ্রাসায় পড়ালে টুপি-দাড়ি-পাঞ্জাবী পরতাম। আপনি আমাকে পড়িয়েছেন ডাক্তারি। তাই টাখনুর উপর প্যান্ট-দাড়ি-টুপি এসব রাখিনি’। এখন দেখা যাচ্ছে লজিকটা মার খেয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা স্পষ্ট দেখতে পায়, আল্লাহ এই ৬ টার একটাকে সামনে এনে বলছেন— ‘এও তো মাদ্রাসায় পড়েনি। এ তো পেরেছে। তুমি এমন কী হয়ে গিয়েছিলে যে পারোনি?’
কী জবাব দেবে ছেলেটা তখন? আছে কোন জবাব?
তৃতীয় ফোঁটাঃ
মুরগি ধরার একটা স্ট্র্যাটেজি হল, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে ওঁত পেতে থাকা। যেসব মুরগি সরাসরি কোন গ্রুপে আসতে চায় না, তাদেরকে সাংস্কৃতিক উইং-এর সদস্য বানিয়ে কর্মী না হোক, স্রেফ সমর্থক বানিয়ে রাখা। আরেক গ্রুপও নিতে পারলো না, আবার কাজেকর্মেও পাওয়া গেলো। কলেজে কালচারাল প্রোগ্রাম বলতে সারা বছরে দুইটা। ছেলেটার গ্রুপ করে সরস্বতী পূজার প্রোগ্রাম, আর বিপরীত গ্রুপ করে ‘সন্ধানী’ বার্ষিক প্রোগ্রাম। ধর্ম যার যার, স্বরস্বতী পূজা সবার। হিন্দুরা কমিটিতেই আছে। স্টেজ সাজানো-পারফর্ম করা-গেট সাজানো- মূর্তি ধরে এনে স্থাপন করা এগুলো মুসলিমদেরই কাজ। নামায-রোযা খুব একটা না করলেও পূজার কাজে উৎসাহের অন্ত নেই তাদের। ছেলেটার আবার ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুবাদে কো-কারিকুলারের তালিম ছিলো ভালোই। এখন বেশ ‘কাজে’ লাগছে।
কাল পূজা। বিকেলে কালচারাল প্রোগ্রাম। পুরো কলেজ সাজানো হচ্ছে। ‘বিদ্যার’ দেবী বলে কথা। স্টেজ ডেকোরেশনের জন্য বিশাল স্বরস্বতীর মূর্তি আঁকা হচ্ছে। ছেলেটা আরো দুই মুসলিম সিনিয়রের সাথে আঁকছে। এর পিছনে লাইট ফেলে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ স্টেজটা বানানো হচ্ছে এবার। ওদের সন্ধানীর স্টেজকে বেশ টেক্কা দেয়া হবে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ব্রাশ করতে করতে বাইরে উঁকি দিল। হুজুরগুলোর হাতে কোদাল, ঝুড়ি। কী ব্যাপার? ওওও, আচ্ছা। হোস্টেলে ডাইনিং-এ ছোট্ট জায়গা নিয়ে মসজিদটা অস্থায়ী । বড় মসজিদ চাই। হুজুররা আরো কিছু হুজুরমনাদের সাথে নিয়ে নেমে পড়েছে জায়গা সাফ করতে। হোস্টেলের সারা বছরের আবর্জনায় মেখে একেকজন যাচ্ছেতাই অবস্থা।
এরা মসজিদ বানানোর জন্য ময়লা মাখাচ্ছে গায়ে, আর ও কি না সরস্বতীর ছবি এঁকে ময়লা হচ্ছে?— ময়লা হচ্ছে তো দুজনই। অথচ কী আকাশ-পাতাল তফাৎ। এক নিমেষ মাত্র চিন্তাটা উঁকি দিয়েই হারিয়ে যায়। মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ছবি আঁকায় ফিরে যায় আমাদের ‘ছেলেটি’।
চতুর্থ ফোঁটাঃ
ফার্স্ট ব্যাচের এক সিনিয়রকে জঘন্য লাগত ওর। ওভার-এক্সপ্রেশান। টেবিল টেনিস খেলছেন তো খেলেন ভাই, এতো টেবিল থাপড়ানো- চিল্লাচিল্লি করার কি আছে? টিটি টেবিলটা আবার ছেলেটার রুমের পাশেই। যা করছে, তার দশগুণ চিল্লাপাল্লা, শো-অফ। বিরক্তিকর। ফাইনাল পরীক্ষার পর ভাইকে অনেকদিন দেখা যায় না। যাক, ক’টা দিন শান্তিতে থাকা গেল, যত্তোসব। হঠাৎ একদিন ভাইকে দেখা গেল। বড় দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবী, মাঝেমাঝে পাগড়ি। কী ব্যাপার? তাকে দেখে আগের মতো বিরক্ত লাগছে না কেন? হাসি দিয়ে প্রথম কথা বললেন— ‘তোমাদের বিভিন্ন সময় কষ্ট দিয়ে থাকতে পারি, মাফ করে দিও ভাই’।
ঘুরে গেল মাথাটা। গা-জ্বলা লোকটা কোন জাদুতে প্রিয়দর্শন হয়ে গেলো। ভাইয়ের রুম থেকে মসজিদে যাবার পথে ওদের রুম পড়ে। যেতে যেতে শান্ত সুরে ভাই ডেকে যেত— আসি ভাই, যোহরের নামাজ, এশার নামায। ফাহিম, সোহেল, আসো ভাই। কোন চেঁচামেচি নেই, কণ্ঠভরা মায়া, যেন কেঁদে কেঁদে ডাকছে কেউ। আমাদের ছেলেটাকে তাবলীগের ছেলেরা দাওয়াত দিতে আসতো না। হয়তো ‘গন-কেস’ মনে করতো। ভাই এসে মাঝে মাঝে ফাহিমকে মসজিদে যাবার দাওয়াত দিয়ে যেতো। কিন্তু ভাইয়ের এই প্রতি ওয়াক্তে হেঁটে যাওয়াটাই আমাদের ছেলেটার জন্য মারাত্মক এক দাওয়াত ছিল, ভাই জানতোও না। ‘সুন্নাহ’ নিজেই দাওয়াত। আপাদমস্তক সুন্নাহ নিয়ে কেউ হাঁটবে, আশপাশের লোকেরা দাওয়াত নিতে থাকবে। সে দাওয়াত জবানের চেয়ে স্পষ্ট, ভাষার চেয়ে শক্তিশালী।
পঞ্চম ফোঁটাঃ
তখন ফাইনাল ইয়ার। ছেলেটা রুমমেটদের সাথে সারারাত তাস খেলত, আর সারাদিন ঘুমাতো। ক্লাসে যেতো না। ৭৫% উপস্থিতি না থাকলে ফাইনালে বসতেই পারবে না— সে চিন্তা ছিল না ওদের। ভাবতো, এতো বছর রাজনীতি করেছি, নেতাদের সেবা করেছি। পরীক্ষায় বসতে না দিলে ‘কাবজাব’ দিয়ে প্রেসারাইজ করে বসে পড়ব। আর বসতে পারলেই একমাসে সব পড়ে উল্টায়ে দিবো। আর বাই চান্স কোন ভাইভা একটু খারাপ হলে পলিটিক্যাল ‘জ্যাক’ দিয়ে তো উতরানো যাবেই। অবশ্য ব্যাচে কেন জানি ওদের ‘মেধাবী’ বলে সুনাম ছিল। কিন্তু মেডিকেলে মেধার চেয়ে জরুরি হল অধ্যবসায়। বুঝবে বাছাধন, বুঝবে।
রুমমেট মুজাহিদের জ্বালায় ওরা অতিষ্ঠ। কমবখতের শরীরটা পাহাড়ের মত বলে ওকে বেশি কিছু বলাও যাচ্ছে না। ইজতিমা থেকে আসার পর পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ছে, প্যান্ট টাখনুর উপর কেটেকুটে একাকার। তাও ঠিক আছে, সই। রাতে তাস খেলার সময় ১০ টা বাজলেই লাইট অফ করতে বলে। আর সারারাত তাস খেলে ফজরের আজান পড়লে ওরা যখন শুতে যাবে, তখন ডাকাডাকি শুরু করে। দোস্ত, ওঠ, ঘুম থেকে নামায উত্তম, নামায পড়ে শো’, সৌর-সোহেল-ফাহিম। উফ, পাহাড়ের সাথে ঝগড়াঝাটি করাও ঠিক হবে না। সারাদিন ঘুমকাতুরে কুম্ভকর্ণ মুজাহিদ তখন আমাদের সারাদিন নসীহতের উপর রেখেছে। হোস্টেলটার হলো কী? কী বড়ি খেয়ে চেনা মানুষগুলো কী রকম জানি হয়ে যাচ্ছে, একদম অচিন মানুষ।
ষষ্ঠ ফোঁটাঃ
আজ একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেছে ছেলেটার সাথে। আজ বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের নির্বাচন ছিল। ছেলেটার গ্রুপের প্রিয় ডাক্তার নেতা বড় পোস্টে লড়ছেন। পুরো গ্রুপ প্রেসক্লাবের সামনে বিএমএ অফিসে গিয়েছিল আজ। ফুলের মালায় বরণ করে নিল বিজয়ী নেতাকে। রাত ১১টার দিকে সবাই ক্যাম্পাসে ফিরছিল। পেয়ে গিয়েছিল ফাঁকা একটা ৮ নম্বর বাস। আসাদগেট আড়ং-এর মোড়ে ধানমণ্ডির দিক থেক ট্রাকটা আসছিল ফুল স্পীডে। বাসে ওঠার সময়ই ড্রাইভারটাকে গড়বড় মনে হচ্ছিল। ছেলেটা, ফাহিম আর মিঠুন ভাই ছিল ড্রাইভারের বামপাশের মহিলা সিটে। ওরা দেখছে ট্রাকটা স্পীড কমাচ্ছে না, বাসওয়ালাও পিনিকে ডানে কাটছে না, সামনেই যাচ্ছে। সবাই হৈ হৈ করে উঠলো একসাথে, চিৎকারে ড্রাইভার কিছুটা হুঁশ ফিরে পেল বোধহয়। পুরো ডানে কাটার চেষ্টা করলো। ভালো একটা ঘষা দিয়ে বেরিয়ে গেল ট্রাকটা।
ক্যাম্পাসে পৌঁছে সবাই ড্রাইভারটাকে পিটিয়ে পুলিশে দিচ্ছে। অন্য সময় হলে ছেলেটাও সোৎসাহে শরীক হত। আজ সে সবাইকে ফেলে হাঁটা দিয়েছে হোস্টেলের দিকে। পিছনে উন্মত্ত জটলা রেখে, ধীরপায়ে। যেনো ঝড়ের বিপরীতে হাঁটছে, ঝড় তো হচ্ছেই কোথাও। সব ঝড় কি দেখা যায়?
৭ম ফোঁটাঃ
খবরটা হলো, ওরা পরীক্ষায় বসতে পারছে না এবার। ৭৫% উপস্থিতি ছিল পরীক্ষায় বসার শর্ত। ৫০% যাদের ছিলো তারাও অনুমতি পেয়েছে। ১ম লিস্ট, ২য় লিস্ট, ৩য় লিস্টেও নাম নেই ওদের। একেকজনের উপস্থিতি ৩০-৩৫% এর বেশি না। পাগলের মতো ছুটছে নেতাদের দুয়ারে দুয়ারে। কিন্তু কোন ‘মেকানিজমে’ই কাজ হচ্ছে না। মিটিং হচ্ছে, কিন্তু স্যাররা নাছোড়বান্দা। না, ওদের বসতে দেয়া হবে না, তাহলে পরের ব্যাচগুলো আর ক্লাস করবে না। আর এবার টাইট দিলে পরের ব্যাচগুলো ক্লাস করবে ঠিকমতো। কোনভাবেই বসতে দেয়া হবে না। নেতারাও বলে দিল,- ‘ঠিক আছে। পরের বার বসো’।
পুরো জীবনে ওরা কখনো ফেল করেনি। ছেলেটা ক্যাডেট কলেজের। তিন জন নটরডেমের। একজন রাইফেলস পাবলিক, একজন বঙ্গবন্ধু কলেজের ফার্স্ট বয়। যতটা না পরীক্ষায় বসা দরকার, তার চেয়ে বেশি ইমেজ ইস্যু। মা-বাবা জানলে, তার চেয়ে বেশি টেনশন— আত্মীয়স্বজন জানলে? এতোটা কঠিন পরিস্থিতি কখনো হয়নি জীবনে। পরীক্ষার বাকি আর ৮ দিন মাত্র। সিগারেটের ধোঁয়া সবাই দেখে, অন্তর পোড়া ধোঁয়া দেখা যায় না।
বিকেলে দরজায় নক। তাবলীগের ভাইয়েরা এসেছে ফাহিমের কাছে। ছেলেটা শুয়ে শুয়ে শুনছে আর জ্বলছে, জ্বালাচ্ছে। আজ মাগরিবের পর পরীক্ষার্থীদের জড়ো করা হবে। কাকরাইল থেকে মুরুব্বিরা আসবেন, এশা পর্যন্ত কথা হবে। এরপর খানাপিনা। প্রতি বছরই আয়োজন হয় নাকি। যে ছেলেটা ডাকতে এসেছে তার শুরুর কথাগুলো কেমন যেন…সবকিছু করনেওয়ালা সত্তা একমাত্র আল্লাহ। ততটুকুই হয় যতটুকু আল্লাহর চান। যাকে আল্লাহ হেফাজত করেন তাকে সারা পৃথিবী মিলে ক্ষতি করতে পারে না, যার ক্ষতি আল্লাহ করেন সারা পৃথিবীর সব শক্তি মিলে তাকে উপকার পৌঁছাতে পারে না…।
বহুদিন পর মসজিদে এলো ছেলেটা। চামড়ার মোজা পরা ছেলেটার কথাগুলো অন্যরকম ছিল একদম। তাই তো, যদি আল্লাহ না চান, কেউ বসাতে পারবে না পরীক্ষায় তাকে, কেউ না। মন দিয়ে বয়ানটা শোনে ও। একজন মুফতি সাহেব, আগে ঢাকা ভার্সিটির ফার্মেসিতে পড়েছেন, পরে কওমীতে মুফতি পড়েছেন। আশ্চর্য সব কথা। সব কথার মাঝে নিজের একটা ঘটনা শোনালেন মুফতি সাহেব। ওনারা ব্রাজিলে ছিলেন জামাতে। ধরুন, বড় একটা ঘর অন্ধকার। আপনার হাতে মোমবাতি। ঘরে আরো কয়েকটা মোমবাতি আছে নেভানো। আপনি যদি আপনার বাতিটা নিয়ে পুরো ঘর ঘোরেন, আঁধার দূর হবে না। কিন্তু যদি নিভে থাকা মোমগুলো জ্বালিয়ে দেন, ঝলমল করে উঠবে সারা ঘর। তাবলীগের লোকেরা তাই বিদেশে থাকা মুসলিমদেরকে দাওয়াত দেয়াকে প্রাধান্য দেয়।
তো ঘটনাটা হল, ওনাদের জামাত ব্রাজিলে চলছিল। মুসলমান খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে, কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষমেশ একটা কবরস্থানে ঢুকে জিরিয়ে নিচ্ছিল সাথীরা। হঠাৎ একটা কবর, নামফলক আরবি। মুসলমানের কবর। বাড়ি সিরিয়াতে। পদবীটা টুকে নিয়ে সারা শহর খুঁজে ফিরলো এই পদবীর লোক। পাওয়া গেলো ৮০ টা পরিবারের বিশাল এক মহল্লা, সবাই খ্রিস্টান, কিন্তু পদবীটা আছে। জামাত ওখানে এক জায়গায় অবস্থান করে সব পরিবারে দাওয়াত পৌঁছালো। স্মরণ করিয়ে দিলো, আরে তোমরা তো মুসলিম, তোমাদের পূর্বপুরুষ মুসলিম, সিরিয়া থেকে এসেছিল। অধিকাংশ পরিবার ইসলামে ফিরে এলো। মোটামুটি ফরজটুকু শিখিয়ে, জামে মসজিদ বানিয়ে, রাজধানী থেকে ইমাম নিয়োগ দিয়ে জামাত অন্য এলাকায় চলে গেল।
আরে, এটাই তো কাজ। সেই পুরনো স্বপ্নটা ফিরে এলো ছেলেটার চোখে। মানুষের হিদায়াতের উসীলা হবার সেই মেজাজ। চল্লিশ দিনের জন্য নাম লিখিয়ে দিল পরীক্ষার পর। দ্বীন শিখবে, দাওয়াত দেয়া শিখবে, আল্লাহর থেকে চেয়ে নেয়া শিখবে। আর দুআ করল— ‘আল্লাহ, এবারের মত পরীক্ষায় বসিয়ে দাও। এক চিল্লার জন্য যাব। বিয়ে করে ‘ভালো হয়ে’ যেতামই, তার আগেই ভালো হয়ে যাব। প্লিজ’। বৃহস্পতিবার এই ঘটনা, শনিবার আবার মিটিং ডাকা হল। বিনা নোটিশে ইমার্জেন্সি মিটিং, যেটা হওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। শনিবারই ফরম ফিলআপ করল ওরা। পরীক্ষার বাকি মাত্র ৬ দিন। ওওও, চাওয়ার জায়গা তাহলে এটাই।
পরীক্ষা শেষ। বাপ-মাও রাজি। চল্লিশ দিন। ওদের মেডিকেলের ৫ জন। কাকরাইল থেকে সিরাজগঞ্জ শহরে। জামাতের আমীর সাহেব আলিম। জীবনের শ্রেষ্ঠ ৪০ দিন। ২৫ বছরের জীবনে প্রথম বসে প্রসাব করা শিখল, বালেগ হবার পর প্রথম ফরজ গোসল শিখল। হাসছেন? হাসবেন না। ৯৫% মুসলমানের বাচ্চার হাল এর চেয়ে খুব বেশি ভালো না বোধ হয়। ১০টা সূরা একদম সহীহ-শুদ্ধ হল, দাওয়াত দেয়া শিখল, নতুন করে কুরআন পড়া শিখল, ঘুম-খাওয়া-বাথরুম এসবের মাসনূন দুআ মুখস্ত হল, জিকির-তাহাজ্জুদের অভ্যাস হল, আর শিখল— ‘শিক্ষার পরিপূর্ণতার জন্য মোট ১২০ দিন লাগবে’। ততদিনে সুখ পেয়ে গেছে। বুঝেছে এটাই কাঙ্ক্ষিত লাইফ ফরম্যাট। আবার ৪০ দিন, এবার জামাতের আমীর আমাদের ছেলেটা, গন্তব্য যশোর। জামাতের সাথীরা যত দুষ্টুমি করে, আমীরের সম্পর্ক আল্লাহর সাথে তত বাড়ে। কিছু হলেই দুই রাকাত নামাযের অভ্যাস হল— ‘ইয়া আল্লাহ, সাথীদেরকে শয়তান থেকে হেফাজত করো। জোড়মিল দিয়ে দাও’।
এর মধ্যে রেজাল্ট হয়ে গেল। তিন সাবজেক্টের তিন ত্রিক্কে নয়টা পরীক্ষা— লিখিত, ব্যবহারিক, ভাইভা। ২ টার ভাইভাতে ফেল আমাদের হিরো। ৬০ এ পাশ, হিরো একটার ভাইভাতে ৫৭, একটাতে ৫৮। নেতা সবগুলো ফেল। যেগুলো ঐ শেষদিন পরীক্ষার অনুমতি পেয়েছিল, সব ক’টা। স্যাররা বললেন, তোমাদের অনেককে পাশ করিয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু যারা এতদিন রেগুলার ক্লাশ করেছে তাদের সাথে অবিচার হত। ২০ দিন পর ফিরে আসতে হল। সাথীদের সে কি কান্না! নিজের ভাই মরে গেলেও এতো কাঁদে না মানুষ। বাসে ফেরার পথে আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতা হল ছেলেটার। বাসে জোরে গান বাজছে, কিন্তু কানের ভিতর ঢুকছে না, মনে হচ্ছে কানের পাশ দিয়ে শব্দগুলো চলে যাচ্ছে। ফেল করেও কোন দুঃখ নেই। আল্লাহ এর মধ্যেই হয়তো ভাল কিছু রেখেছেন। হয়তো পাশের যোগ্য ছিল না ও। হয়তো আবার কি? আসলেই তো পড়া হয়নি কিছুই। ৩ মাস পর সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা। মেডিসিন-সার্জারী পড়ে তামাতামা করে ফেলতে হবে এবার।
পরীক্ষা শেষে? ১২০ দিন তো পুরো হয়নি। আবার ঐ পথেই। দেশী-বিদেশী জামাতের সাথে, কত মানুষ! কত গুণ! কতকিছু শেখা! বড় বড় কিছু জরুরি সূরা মুখস্ত হয়ে গেল, তাহাজ্জুদে পড়াও যাবে, ওযীফা হিসেবে পড়াও যাবে। দাওয়াতে আরো পরিপক্বতা এলো। জীবনের প্রথম খতম হল কুরআন। ইসলামী জীবন অভ্যাসে এসে গেলো। অসুখ কম হলে ঘরেই সারে, কিছু অসুখের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। পরিবেশ সবচেয়ে বড় জিনিস। ১২০ দিন এই পরিবেশেরই নাম, মসজিদের পরিবেশ। এখন দরুদ পড়লে মুখে মিষ্টি টের পায় ছেলেটা, তাহাজ্জুদে লম্বা সূরা আর চোখের পানি, আর নিঃশ্বাসে মিন্ট ফ্লেভার। হায়! তোমরা যদি জানতে। এখন অবশ্য সে ফিলিংস আর নেই।
ইন্টারের রসায়ন ব্যবহারিকে ‘টাইট্রেশন’বলে একটা কথা আছে। লবণ নির্ণয় করা। ফোঁটা ফোঁটা কী জানি ফেলে শেষ ফোঁটায় রঙ পরিবর্তন হয়। নীল হলে কপার সালফেট, এটুকু মনে আছে। কয় ফোঁটা গেল মনে রাখতে হয়, ঘনত্ব হিসাব করার জন্য। হিদায়াত হল টাইট্রেশন। ফোঁটা ফোঁটা পড়তে পড়তে শেষ ফোঁটায় জীবন পরিবর্তন, রাস্তা পরিবর্তন। এজন্য কেউ জীবনের পরিবর্তন চাইলে বেশি বেশি ফোঁটা নিতে হবে— ভাল কিতাব, দ্বীনী বন্ধুর সাহচর্য, আলিমগণের সোহবত, মসজিদের পরিবেশ, দাওয়াত- এগুলো ফোঁটার জায়গা। কেউ জানে না কয় ফোঁটা লাগবে, তাই বেশি বেশি ফোঁটা ফেলুন। আর দুআ তো আছেই, নামাযে সূরা ফাতিহার ‘ইহদিনাস সিরাত্বাল মুস্তাক্বীম’ পড়ার সময় বেশি করে আবেগ ঢালুন, করেই দেখুন না।
শায়খ যুলফিকার আহমদ নকশবন্দী (দাঃ বাঃ) একটা দুআ করেন—
ইয়া আল্লাহ, অনেকটা সময় চলে গেছে জীবনের। তোমার থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। ‘বহত দূর সে আয়া হু, বহত দেড় মে আয়া হু, আয়া তো সহি’। অনেক দূর থেকে এসেছি, অনেক দেরী করে এসেছি। এসেছি তো। মাফ করেই দাও, মালিক।
ছেলেটার ‘কাছে আসার গল্প’ আজ এপর্যন্তই। অন্য ফোঁটাগুলো অন্য কোন দিন শোনাবো আপনাদের।
ছেলেটা এখন দুনিয়ার ক’টা দিন ইঁদুরের মতোই বাঁচতে চায়।