SHAMSUL AREFIN SHAKTI·WEDNESDAY, JANUARY 2, 2019
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে লাগিয়েছিলেন। কত দেশের কত নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয়। একেকটা মানুষ মনে হয় একেকটা কিতাব, কয়েকখণ্ডে সমাপ্ত। একজন মানুষের ভিতরেই কত কিছু জানার, কত কিছু শেখার। আপনি বই পড়ে একটা হাদিস শিখতে পারেন, কিছু মাসয়ালা শিখে নিতে পারেন। কিন্তু কিছু জিনিস আপনাকে কেউ শিখাতে পারে না, দুনিয়ার কেউ বলতে পারবে না আমি এসব শিখাতে পারি। তাকওয়া কিভাবে করে, তাওয়াক্কুল কীভাবে করতে হয়, শোকর-সবর, বিনয়, নামাযের ধ্যান, আমলে লেগে থাকা— এগুলো কোন কিতাব শিখাতে পারে না। এসব আল্লাহ তাআলা খোদ শিখান। হার্ডওয়্যার দোকানে পাবেন, কিন্তু সফটওয়্যার উপর থেকে ডাউনলোড করতে হয়। এজন্য আত্মশুদ্ধির একটা মাধ্যম হল— ‘কুনু মাআস সদিক্বীন’, নেককার লোকদের সোহবত। তাবলীগের মাধ্যমে পরিচিত এই শত শত মানুষের কেউ আমার তাকওয়ার শিক্ষক, কাউকে দেখে শিখেছি তাওয়াক্কুল কাকে বলে, কেউ আমাকে শিখিয়েছে ‘রিদ্বা-শোকর-সবর’ কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি। কারো বিনয় দেখে নিজেরও ইচ্ছে হয়েছে এমন বিনীত আর সরল যদি হতাম। কারো নামায আমাকে নতুন করে ভাবিয়েছে ধ্যান কী জিনিস। এক সাথী মাঝরাতে প্রতিদিন একই সময় উঠে কাঁদত, একই সময় টানা ৪০ দিন, কীভাবে পারো ম্যান। আল্লাহর শুকরিয়া যে আল্লাহ আমাকে এসব লোক দেখিয়েছেন।
দাওয়াতের হিকমাহও একটা শেখার জিনিস। কিশোরগঞ্জ সফরে আমির সাহেব সাজ্জাদ ভাই, বন্ধু মানুষ। যেকোন মুরুব্বি বয়েসী কারো কাছে গাশতে (দাওয়াতে) গেলে সালাম মুসাফাহা দাওয়াতী কথাবার্তার পর বা আগেই বা মাঝে কোন মওকায় মুরুব্বির হাতটা নিয়ে নিজের মাথায় রেখে বলতো, চাচা, আমার জন্য দুআ করবেন। মুরব্বি ঠিক ঠিক সাজ্জাদ ভাইকে আবার দেখতে পরের কোন ওয়াক্তে মসজিদে চলে আসত, অন্তর গলে যেত। এই সামান্য ‘হাত মাথায় নেয়া’ও শিখার চীজ? শাইখ ইলিয়াস রাহিমাহুল্লাহ বলতেন, আমার এই মেহনত ‘খুবিয়োঁ কা লেনদেন হ্যাঁয়’, গুণের আদানপ্রদান। প্রতিটি মানুষের মাঝে গুণ তালাশ করলে ঐ গুণ আমারও পেতে ইচ্ছে হবে। আর দোষ খোঁজার পিছনে পড়লে ঐ দোষ আমার ভিতরেও এসে যাবে। এজন্য জ্ঞানের অন্যতম এক মাধ্যম হল— সফর। সালাফগণ জ্ঞানের জন্য সফর করাকে সাধারণ আমল হিসেবে নিয়েছিলেন। ভূমিকা শেষ, এবার আসল কথা পাড়ি।
সন্তানের শিক্ষার তো অনেক ব্যবস্থা আছে। কিন্তু দীক্ষাটা হবে কীভাবে? শিক্ষা দেবার জন্য অনেকে আছে। কিন্তু দীক্ষার জন্য আসলেই আপনি ছাড়া আর কেউ নেই, খেয়াল করে দেখেন। আমার এক আত্মীয় তার ৪ বছরের বাচ্চা নিয়ে খুব চিন্তিত, কোন স্কুলে দেবে, কোন কিন্ডারগার্টেন ভাল, ইত্যাদি। তো তাকে বললাম, ভাই, আপনার বাচ্চা এই যে কিন্ডারগার্টেনে ঢুকবে, হোমওয়ার্কে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আর এই ব্যস্ততা থেকে সে অবসর হবে যখন তার বয়েস হবে ৫৯, রিটায়ারমেন্টের সময়। এর মাঝে আর অবসর নেই। সন্তানের জন্য শ্রেষ্ঠ শিক্ষা হল, যা তার বাবা তাকে দেয়। এখন স্কুলে না দিয়ে আপনি নিজে তাকে সময় দেন, নিজে শেখান। স্কুল তাকে ঐ জিনিস শেখাবে না যা আপনি তাকে শেখাবেন। আর যা তাকে আপনি এখন শেখাবেন সেটাই সে সারাজীবন লালন করবে, সেটাই তার ব্যক্তিত্ব গঠন করবে, সেটাই হবে ‘সে’। তাই এই সময় তাকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে না দিয়ে আপনি তাকে শেখান। একই উপদেশ দিয়েছি আরেক আত্মীয়কে, সে গল্প করতে এসেছিল যে, তার ক্লাস ২ এর ছেলেকে পড়ানোর জন্য ম্যালা ট্যাকা দিয়ে বুয়েটের স্টুডেন্টকে রাখা হয়েছে। চান্সে তাকেও কিছু ফ্রী কনসাল্টেশান দিয়েছি, মিঞা নিজে সময় দেন, নিজে শেখান। প্লিজ বইলেন না, সময় পাইনা। আপনি সময় না পাওয়ার অর্থ হল, আপনার প্রায়োরিটি লিস্টে এটা নেই। ‘সন্তানকে সময় দেয়া’-কে প্রায়োরিটি দিবেন না, আবার বুড়াকালে অভিযোগ করবেন— আমার ছেলে আমাকে সময় দেয় না, বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছে। এগুলো ডাবল স্ট্যান্ডার্ড।
জাবির ইবনু সামুরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ নিজের সন্তানকে শিষ্টাচার ও আদব-কায়দা শিক্ষা দেয়া এক ‘সা’ পরিমাণ বস্তু দান-খাইরাত করার চেয়েও উত্তম।
আইউব রহঃ আপন পিতা থেকে, তিনি আপন দাদা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কোন পিতা আপন সন্তানদেরকে উত্তম শিক্ষা ও আদব দান করার চেয়ে উত্তম কোন উপহার দেয়নি।
১৫ দিনের জামাতে টাঙ্গাইলে ছিলাম। মহিলারা কোন পর্দাঘেরা বাসায়, আর পুরুষগুলো মসজিদে। যে ঘর দেয়, সে সহ ঐ ঘরের সব বালেগ পুরুষ থাকবে মসজিদে। পুরুষরা মহল্লায় দাওয়াত দিয়ে সব পুরুষকে বলবে যেন ঐ বাসায় তাদের মহিলাদের পাঠায়। মহল্লার সব মহিলাদের আনাগোনায় ভরে ওঠে ঐ বাসাটা, আর জামাতের মহিলারা দাওয়াত, মেহমানদারির আমল করেন উনাদের উপর। উনারা নিজ চোখে দেখে নেন দীনী জীবন, দীনী আচরণ, দীন মানার চেষ্টা কেমন করে করছে মানুষ। দেখে নিজেদের মধ্যে দীনপালনের আগ্রহ আসে। প্রতি বাসায় ২ দিন করে থাকা হয়। তো এই পনের দিনে ৮ টা পরিবারের সাথে সময় দেয়া হলো। একেক পরিবার থেকে কত কিছু শেখার। কোন পরিবারে বাচ্চাকে কীভাবে মানুষ করছে, এগুলোও আল্লাহ দেখিয়েছেন।
পল্লবীতে এক বাসায় ৫ বছরের মারইয়াম কোন পুরুষের সামনে আসবে না। শুধু মা যার যার সামনে যায়, সে-ও তার তার সামনে যায়। আমার ছোটবোন তাকে টেনে হিঁচড়ে আমার সামনে আনার চেষ্টা করছে। আর সে বলছে, ‘ছেলেদের সামনে যেতে হয় না, যেতে হয় না’। বাচ্চাদের শেখাই হোক আর এডাল্ট লার্নিং-ই হোক, দেখে আমরা যা শিখি বা মনে রাখি, শুনে বা পড়ে তা শেখা দুষ্কর। হাদিসেও তো নফল নামায ঘরে পড়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেয়া হয়েছে, বাচ্চারা দেখে শিখবে। আমার খাদীজা ১ বছর বয়েসে দেখতাম সিজদা করে, বুকে হাত বেঁধে মুখ বিড়বিড় করে। মাকে দেখে দেখে শিখেছে। তারপর কোন আকাম করার পর, যেমন ঘরে পানি ফেলেছে বা ইত্যাদি, মাথায় হাত দিয়ে ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ করে মাকে ডাকতে যেত, পুতুল কোলে নিয়ে আল্লাহ আল্লাহ বলে ঘুম পাড়াতো। এখন অবশ্য এসব আর করে না। শিশুরা ভয়ংকর রকম অনুকরণপ্রিয়। আপনি যা করবেন ও তাই শিখবে। তাই সর্বপ্রথম বাবাকে, আরও বেশি মা-কে সুন্নাতের পাবন্দ হতে হবে। ডান হাতে খাওয়া, বাম পায়ের জুতো আগে খোলা, ডান কাতে ঘুমানো এসব ও আপনাকে দেখেই শিখবে। আপনাকে দেখে দেখেই সুন্নাতের গুরুত্ব আর ভালোবাসা, সেই সাথে অভ্যাস এসে যাবে ওর ছোট্ট মনে।
তাবলীগের মুরুব্বি ইঞ্জিনিয়ার হাজী আবদুল মুক্বিত রাহিমাহুল্লাহর একটা ঘটনা শুনেছিলাম। উনার সদ্যপ্রসূত নাতনীকে একটা পাতলা সাদা কাপড়ে ঢাকা দেখে একজন জিগ্যেস করল, হুজুর, এত ছোট বাচ্চা ঢেকে রেখেছেন গরমে। উনি বললেন, একটা ছোট বাচ্চার তো তাই আছে যা একজন বড় মানুষের থাকে। তারও সতর আছে। ছোট থেকেই বাচ্চাদের হাফপ্যান্ট ইত্যাদি পরানো অনুচিত। বরং ছোট থেকেই সুন্নাতী পোশাকে অভ্যস্ত করানো চাই। এক সাথীর ৩ বছরের ছেলে বাচ্চা হুটোপুটি করতে গিয়ে আমার সামনেই উরুতে মারাত্মক ব্যাথা পেল। আমি এতো দেখতে চাইলাম উরুতে কেটে ছড়ে গেছে কি না, পায়জামা উঠাতেই দিলো না। বাপ বলল, হাঁটুর উপরে কাপড় উঠাতে লজ্জা পায়। সুন্নাতকে যেন আপন, আর অন্যান্য তরিকাকে যেন পর মনে করা শেখে। ইউরোপীয় কাটিং-এর পোশাককে যেন ‘অস্বস্তিকর’ মনে করতে শেখে। আমার ভায়রার ৪ বছরের মেয়েটা, আমি খালু হই, আমার কোলেও আসে না। শুধু বাপ-মা-খালা-চাচা ছাড়া কারো কোলে যাবে না। একবার এক দারওয়ান তাড়াতাড়ির মধ্যে কোলে করে বাসায় উঠিয়ে দিয়েছিল বলে কী রাগ। আমার সামনে আসবে, কিন্তু উঁহু, কোলে নেয়া যাবে না।
বাসায় প্রতিদিন কিছু সময় সম্মিলিত তা’লিম করবেন। উমার রা. তাঁর বোনের তালিমের হালাকায় গিয়েই হিদায়াত পেয়েছিলেন। বোন ফাতিমা বিনতে খাত্তাব, বোনাই সাঈদ রা. আর উস্তাদ খাব্বাব ইবনে আরাত রা. কুরআনের তা’লিম করছিলেন। রোজানা বাসায় আধঘণ্টা বা সুবিধামত তা’লিম করা দরকার। সব হাদিসের কিতাব তা’লিমের জন্য উপযুক্ত না। আদাবুল মুফরাদ, রিয়াদুস সালিহীন, মুন্তাখাব হাদিস, বা আলিমগণের পরামর্শমত অন্য কোন কিতাব থেকে চ্যাপ্টার ধরে ধরে দুটো-একটা করে হাদিস পড়লে আনন্দের সাথে মনোযোগ ধরে রাখা যাবে। বিরক্তি না আসে যাতে, যেহেতু প্রতিদিন করা হবে। এজন্য লাভ-ফযীলত বেশি থাকলে মজা পাওয়া যাবে। এসব হালাকায় বাচ্চাদের নিয়ে বসতে হবে, এমনকি দুধের শিশুও। কেননা এসব দীনী হালাকায় সাকিনাহ নামক বিশেষ রহমত নাযিল হয়, যা থেকে বাচ্চাও যাতে বঞ্চিত না হয়। শাইখ উমায়ের কোব্বাদি হাফিজাহুল্লাহ বলেছিলেন, বাসায় দৈনন্দিন যিকির-আযকারের সময় একটু উচ্চৈঃস্বরে জিকির করবেন মাঝে মধ্যে, বাচ্চারা মজা পাবে, জিকিরের আগ্রহ পাবে, তারও অভ্যাস গড়ে উঠবে।
বাচ্চাকে কাছে নিয়ে খেলাচ্ছলে তার আকীদা গড়ে তুলতে হবে। তুমি কে? আমি কে? আল্লাহ কে? রাসূল কে? খাওয়ায় কে? পালন করে কে? এক জামাতের আমীর সাহেব ছিলেন, তাকে দেখতাম বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে মসজিদে আসা শিশুদেরকে দাওয়াত দিতেন। তোমার এই জামাটা কে দিয়েছে? বাচ্চা মানুষ; বলল, আব্বা কিনে দিয়েছে। তখন তিনি তাকে বাচ্চা বাচ্চা ভাষায় বুঝিয়ে দিতেন, না, তোমার আব্বা তো কিনে এনেছে, কিন্তু দোকান পর্যন্ত এনে দিয়েছেন আল্লাহ। আম্মা খাওয়াননি তোমাকে, আম্মা তো তাই রেঁধেছেন, যা আল্লাহ পাঠিয়েছেন। আমরা দাওয়াত দেবার জন্য বড় মানুষ খুঁজতাম, আর উনি দেখতাম বাচ্চাদের নিয়ে ঈমানী হালাকা দিচ্ছেন।
একজন সালাফের শৈশব খুব আলোচনায় আসত বার বার। আমি কোন এক বইয়ে সেই সালাফের নামও পড়েছি, এখন মনে করতে পারছি না। ছোটবেলায় ঘরে এসে যখন খাবার চাইতেন, মা বলতেন, খাওয়ান তো আল্লাহ; তুমি দুই রাকাত নামায আদায় করে আল্লাহর কাছে চাও। ছেলে নামাযে দাঁড়াত, আর মা খানা গুছিয়ে দিতেন। ছেলে এসে দেখত খানা রেডি। এভাবে প্রতিদিন ছেলে মক্তব থেকে এসে দু’রাকাত পড়ত, খানা পেত। একদিন মা কাজের ডামাডোলে ঠিকসময়ে এসে পৌঁছতে পারলেন না। মা পেরেশান হয়ে গেলেন, আজ আমার সন্তানের ইয়াকীন নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলেন, ইয়া আল্লাহ, আমি ছোটবেলা থেকে আপনার প্রতি আমার ছেলের ইয়াকীন তৈরি করেছি। আজ আপনিই তার ঈমানের হেফাজত করুন। বাড়ি এসে জিগ্যেস করলেন, বেটা খানা খেয়েছো? ছেলে জবাব দিল, আম্মা, আজকের খানা তো এতো সুস্বাদু ছিল যে এত স্বাদের খানা আমি কোনোদিন খাইনি।
শাইখ আবদুল কাদির জিলানী রাহিমাহুল্লাহর ঘটনাটাও খুব আলোচনা হত। বাগদাদে পড়তে যাবার সময় কাফেলা লুট হল। শিশু জামার ভিতরে সেলাই করা গোপন পকেট থেকে দিনার বের করে দিয়ে দিল। ডাকাত বলল, তুমি কেন দিলে, আমরা তো খুঁজে পেতাম না। তিনি বললেন, আমার মা আমাকে মিথ্যে বলতে নিষেধ করেছেন। তোমরা না জানলেও আল্লাহ তো জানবেন যে আমি মিথ্যে বলেছি। ছোটবাচ্চার এই তাকওয়া দেখে ডাকাতদল তাওবা করল। আকীদা শেখানোর জন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঐ হাদিসটাকে সামনে রাখতে পারেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপন নাবালক চাচাত ভাই আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-কে আকীদা শেখাচ্ছেন: [1]
– হে বালক, আল্লাহকে হেফাজত কর, তাহলে আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন।
– আল্লাহকে হেফাজত কর, তাহলে তাঁকে তোমার সাথেই পাবে।
– স্বাচ্ছন্দ্যের সময় আল্লাহকে চিনো, তাহলে বিপদের সময় তিনি তোমাকে চিনবেন।
– যখন কিছু চাইবে, আল্লাহর কাছেই চাইবে।
– যখন সাহায্য লাগবে, আল্লাহর দিকেই ফিরবে।
– যা যা ঘটবে, তা লেখার পর কলমের কালি শুকিয়ে গেছে।
– সমগ্র সৃষ্টিজগত যদি একত্র হয়ে তোমার এমন কোন উপকার করতে চায়, যা আল্লাহ নির্ধারিত করে রাখেননি, তাহলে তারা তা করতে সমর্থ হবে না।
– আর তারা যদি তোমার এমন কোন ক্ষতি করতে চায়, যা আল্লাহ নির্ধারণ করেননি, তাহলে তারা সে ক্ষতি করতে পারবে না। জেনে রেখো, অপছন্দনীয় জিনিস ধৈর্যের মাধ্যমে সহ্য করার মাঝে আছে মহাকল্যাণ।
– বিজয় রয়েছে ধৈর্যের মধ্যে; কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি; আর কঠিন অবস্থার সাথে রয়েছে সহজতা।
কিংবা সূরা লোকমানে বর্ণিত লোকমান হাকিমের উপদেশ সামনে নিয়েও সন্তানকে কোলের মধ্যে করে শেখাতে পারেন:
– হে বৎস, আল্লাহর সাথে শরীক করো না। নিশ্চয় আল্লাহর সাথে শরীক করা মহা অন্যায়।
– হে বৎস, কোন বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তর গর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ গোপন ভেদ জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।
– হে বৎস, নামায কায়েম কর, সৎকাজে আদেশ দাও, মন্দকাজে নিষেধ কর এবং বিপদাপদে সবর কর। নিশ্চয় এটা সাহসিকতার কাজ।
– অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।
– পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন কর এবং কন্ঠস্বর নীচু কর। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।
এক সাথীভাই বাচ্চা কোন ভুল করলে বলতেন, যাও দু’রাকাত নামায পড়ে আল্লাহর কাছে মাফ চাও। ছোট থেকেই আল্লাহভীতি গড়ে উঠবে এভাবে। মিথ্যা বলা, মারামারি, কোন কিছু ভেঙে ফেলা— সব কিছুর একই শাস্তি, আল্লাহর কাছে মাফ চাও।
হায় কত বাচ্চা বলিঊডের খানদের চেনে, চার খলিফাকে চেনে না। এক সাথীভাই তার ছোট চাচাতো ভাইকে বলছে, কালিমা পড়ো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। ৫ বছরের বাচ্চা বলছে, কেন পড়ব, এটা তো ফকিরদের গান। সেই ভাই শেখানোর চেষ্টা করতেই, বাপমা বলে ওঠে, এতো বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। অথচ ‘ব্যা ব্যা ব্ল্যাকশীপ’ বা ‘টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল’ ইত্যাদি অর্থহীন কবিতা এমনকি অপরাধী গান পর্যন্ত আমরা বাচ্চাদের মুখস্ত করাই। বাবা, আঙ্কেলকে একটা কবিতা শোনাও তো। তার মানে সূরা শেখালে তাও পারতো। উচ্ছে গাছ লাগিয়ে আমের স্বপ্ন দেখার উম্মাত আমরা। এই বাচ্চাই বড় হয়ে বাপমাকে না জানিয়ে প্রেম করে বিয়ে করলে, গায়ে হাত তুললে আবার কত কান্নাকাটি। মুফতি মনসুরুল হক হাফিজাহুল্লাহ এক বয়ানে বলেছিলেন, সে সন্তান আল্লাহকে চেনে না, আল্লাহর রাসূলকে চেনে না, সে বাপমাকে কি চিনবে, বাপমায়ের হক কী বুঝবে। এজন্য যদি আলিম নাও বানাতে চান, প্রথম দু’য়েক ক্লাস মাদরাসায় পড়ানো উচিত। এমন পরিবারও আমরা পেয়েছি, ৫ বছরের বাচ্চা ছোট ছোট সূরাগুলো মুখস্ত, ঘুমের দুআ-খাওয়ার দুআ এসব ছোট ছোট দুআগুলো মুখস্ত, এমনকি অনর্গল দাওয়াতের মূল কথাগুলোও বলে দিচ্ছে। এটা ব্রেন ডেভেলপমেন্টের সময়, যা শেখাবেন, যে সফটওয়্যার ইন্সটল দেবেন, তা পার্মানেন্ট হয়ে যাবে।
যতটা সম্ভব ইউটিউবের কার্টুন ইত্যাদি থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা চাই। আল্লাহ আমাকে তাওফীক দিন। তবে আমার ভায়রাকে দেখেছি আলাদা করে ডাউনলোড করে রাখতেন মিউজিক ছাড়া আরবি কার্টুন। ওগুলো দেখে আরবি আরও চোস্ত হয়েছে। তবে মিউজিকের খারাপ প্রভাব থেকে বাঁচানো খুব জরুরি। অন্তরের নূর নষ্ট হয়ে যায়। বাচ্চার খানা যিকিরের সাথে পাক করা চাই। দুধের বাচ্চাকে খাওয়ানোর সময় সর্বদা ডানপাশ থেকে শুরু করা, বামেরটা খাওয়ানো উদ্দেশ্য হলেও ডান থেকে শুরুটা হওয়া দরকার। কোন বুজুর্গের মায়ের ঘটনা যেন শুনেছিলাম, সবসময় দুধপান করাতেন অযু অবস্থায়। মাইন্ড ইট, এই সন্তান আপনার ‘আমল’, যেটা আপনি দুনিয়াতে রেখে যাবেন। এখন কবরে বসে নেকী পেতে চান, না কি গুনাহ কামাতে চান, সে ফয়সালা এখনই করতে হবে, টাইম কম।
ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “এই উম্মাতের শেষের দিকে যে লোকেরা আসবে, তাদের সংশোধন সেই পর্যন্ত হতে পারে না, যে পর্যন্ত না তারা প্রথম যুগের সংশোধনের পন্থাকে গ্রহণ না করবে”। দীনকে শুধু মসজিদ আর মাদরাসায় সীমাবদ্ধ না রেখে ঘরে নিয়ে আসতে হবে। ঘরে নফল নামাযের দ্বারা মসজিদের পরিবেশ, যিকিরের দ্বারা খানকাহের পরিবেশ, আর তা’লিমের দ্বারা মাদরাসার পরিবেশ প্রতীকীভাবে কায়েম করতে হবে। তাহলে এই ঘর থেকেও ‘কুরআনের পাখি’ না শুধু; ‘কুরআনের বাঘ’ ‘কুরআনের সিংহ’ বের হবে ইনশাআল্লাহ। পরিবেশ বানান, যেমন পরিবেশ বানাবেন, তেমন প্রোডাক্ট বের হবে। এখন সালাহউদ্দীন আইউবী চান, না ব্রয়লার মুরগী চান, এ সিদ্ধান্ত আপনার।
আল্লাহ আমাদের ঘরগুলোকে মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ হিসেবে কবুল করুন।
ঘরে ঘরে নেক সন্তান দান করুন।
[1] মুসনাদে আহমাদ, নং ২৮০৩; সহীহ। এই একটা হাদিস নিয়ে একটা কিতাব আছে ইমাম ইবনু রজব হাম্বলী রহ. এর— ‘নূরুল ইকতিবাস’। বইটি ‘নবীজীর পদাঙ্ক অনুসরণ’ নামে সীরাত পাবলিকেশান থেকে প্রকাশিত হয়েছে।