সন্তানের শিক্ষা

SHAMSUL AREFIN SHAKTI·THURSDAY, JANUARY 3, 2019

 জরুরি কিছু বাদ পড়ে গেল কি না, যা আলোচনার দরকার ছিল। এগুলো বইয়ে থাকবে। আমি আলোচনাগুলো আরও কমপ্লিট করার জন্য ফেবুতে দিচ্ছি। আগের নোটগুলোতেও সংশোধন থাকলে
আপনারা জানাবেন। আল্লাহ জাযা দিবেন ইনশাআল্লাহ।  

দীনী কমিউনিটির মা-বাবাদের একটা অন্যতম পেরেশানির বিষয় হচ্ছে সন্তানের শিক্ষা। অনেকেই ইনবক্সে বা বিভিন্ন সাক্ষাতে সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই অংশটা এক্সক্লুসিভলি জেনারেল শিক্ষিত, কোন আলিমকে কখনো এটা নিয়ে পেরেশান হতে শুনিওনি, দেখিওনি। কেননা দীন বুঝার পর জেনারেল শিক্ষার উপর, এর ফরম্যাট-কারিকুলাম-সহশিক্ষা-কোচিং বাণিজ্য এসবের উপর থেকে মন উঠে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। যে শিক্ষা আমাকে এতোদিন আল্লাহকে চিনতে দেয়নি, দীন বুঝতে দেয়নি, কুফফার কালচার-জীবনযাত্রার দিকে আকৃষ্ট করেছে, আমি স্বাভাবিকভাবেই চাইব না আমার সন্তানও একই প্রসেসে ঢুকুক। আবার বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে যে নামটা আসে সেটা হল, কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা। আমি শিক্ষাধারা বলতে মোটাদাগে এই দুটো ধারার কথাই বলব। কেননা, আলিয়া, ভোকেশনাল এসবকে জেনারেল শিক্ষাধারা মনে করবার যথেষ্ট কারণ আছে। এই ধারাটার উদ্দেশ্য-ফরম্যাট-আউটপুট অধিকাংশ ক্ষেত্রে পার্থক্য করার মত নয়, ব্যতিক্রম ছাড়া। উদ্দেশ্য-ফরম্যাট-আউটপুট দেখলে ভিন্ন একটা ধারাই নজরে আসে, কওমী ধারা। দীনপালনে আগ্রহী জেনারেল শিক্ষিত অংশটার কাছে এই কওমী ধারাটা খুব একটা পরিচিত নয়। যাদের কাছে পরিচিত তাদের একটা বড় অংশের কাছে সন্তানের ভবিষ্যত ক্যারিয়ারের চিন্তাটা একটা প্রতিবন্ধকতা ছিল, যা স্বীকৃতির পর অনেকটাই সমাধান হয়ে গেছে। আরও বেশি সংখ্যক মা-বাবা এখন সন্তানকে কওমীতে দেবার ব্যাপারে আগে যে দ্বিধায় ভুগত, তা কেটে গেছে বলেই আমার মনে হয়। এখন আরেকটা সমস্যা হল, হিফজখানায় ছোট বাচ্চাকে আবাসিক দিয়ে দেয়া, বা কিতাবখানার ছোট ক্লাসে বাচ্চাকে এতো আগেই আবাসিক দেয়া অনেক জেনারেল অভিভাবকের জন্যই কষ্টকর। আমি জাহেল মানুষ এসব নিয়ে কথা না বলাই ভালো। বরং আজ প্রি-স্কুল সন্তানের শিক্ষাটা কেমন হতে পারে, বা স্কুল-মাদ্রাসা যেখানেই দেন না কেন, বাসায় তার সাইড-শিক্ষাটা কেমন হতে পারে তার একটা আউটলাইনে পৌঁছতে চেষ্টা করা যাক।

আমি আমার শ্বশুরের ৩ নং জামাই। ‘৩ নাম্বার’ শুনলে কেমন কেমন লাগলেও, আমি কিন্তু খুব আদরের জামাই। তবে জামাইদের মধ্যে সবচেয়ে আদরের মনে হয় আমার মেজ ভায়রা। কারণ হল, উনি খুবই বৈষয়িক, মানে প্র্যাক্টিক্যাল এবং হাইলি র‍্যাশনাল। শ্বশুর বৈষয়িক নানা বিষয়ে ওনার মতামত নেন এবং আমার কাছে মতামত চেয়ে লাভ নেই এটাও উনি জানেন। এক্স-বুয়েট সিএসই, আর এক্স-ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ। জার্মানি আর ব্রিটেনে ডাবল এমএস করা। আমি নিজের সীমাবদ্ধতাগুলো খুব ভালো করে জানি। কে যেন বলেছিল, আমি কী পারি এটা জানাটা জ্ঞান না, বরং আমি কী পারি না, এটা জানাটাই প্রকৃত জ্ঞান। সেদিক থেকে দেখলে আমি আসলে বেশ জ্ঞানী। লেখালেখি করার আগেও খুবই বেখেয়াল ভাবালু ছিলাম, এখন আরও বেড়েছে। এ কারণে আমি পেশাগত জীবনে একজনের সাথে লেজ হিসেবে লেগে গেছি। সে যখন যা করে আমিও তাই করি, আমার কলিগ ডা. শামীম রেজা, কষ্টিপাথর বইয়ে তার নাম আছে। সে যখন ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা দেয়, আমিও দেই। সে যখন ফাউণ্ডেশন ট্রেনিং-এ যায়, প্রভিডেন্ট ফান্ড খোলে, আয়কর রিটার্ন দেয়, আমিও সাথে সাথে করি। কারণ আমি জানি, স্বাধীনভাবে করতে গেলে আমার খেয়াল থাকবে না। তেমনি পরিবার ও শ্বশুরবাড়ির বিষয়গুলোতে আমি আমার মেজ ভায়রার সাথে নৌকা বেঁধে দিয়েছি। উনি যা করে, আমিও তাই করি। সন্তানের পড়াশুনার ব্যাপারেও ঠিক করেছি উনি যা করবেন, তাই করবো। ওনার মেয়েটার বয়স ৫ বছর, ছেলেটা ৩। বাচ্চাদের মায়ের শিক্ষা আরবি মিডিয়াম, তারপরও উনি নিজেও আরবি শিখেছেন। বাচ্চাদুটো নিজেদের মধ্যে অনর্গল আরবি বলে এই বয়সেই। মেয়েটাকে কোথায় দেবেন এই চিন্তায় চিন্তায় ৪/৫ টা স্কুল-মাদ্রাসা দেখা শেষ।

ওনার একটা কথা আমি খুব গেঁথে নিয়েছি। শুনবেন? সেটা হলো, বিদেশীরা যখন আমাদের স্কলারশিপ দেয়, তখন আমাদের সিজিপিএ মানে ‘সাবজেক্ট কতটা জানি’ এটা বেশ গৌণই হয়ে যায়। ওরা প্রধানত দুটো জিনিস দেখে—

১. ভাষার উপর কতটা দখল?

২. এনালাইসিস বা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা কতটুকু?

বিদেশীরা স্রেফ এটুকুই দেখে আপনি ভাষায় কতটা পারদর্শী আর আপনার বিশ্লেষণী ক্ষমতা কতটুকু। উনি উদাহরণ হিসেবে SAT আর GRE-র কথা বললেন, আমার অবিশ্যি খুব বেশি ধারণা নেই। তবে আমি এটূকু জানি আমাদের IBA-র ভর্তি পরীক্ষা ঐ ধাঁচেরই। আর নিজে ISSB দিয়েছিলাম, আর্মিরাও এই দুটোই দেখে। আপনি আপনার সন্তানের এই দুটো স্কিল একটু কষ্ট করে গড়ে দিতে পারলে সে যে সাবজেক্টেই পড়ুক, ভালো করবে। সে যদি, ‘তকদীরের ফেড়ে’ সবচেয়ে নিম্নমানের সাবজেক্টও পায়, সে ঐ সাবজেক্টেই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে, উদ্ভাবনী দক্ষতার মাধ্যমে। আমরা একটু পয়েন্ট বাই পয়েন্ট আলোচনা করি, তাই না? তাহলে বুঝে চর্চা করতে সহজ হবে ইনশাআল্লাহ। যেহেতু ‘দীন মানতে চাওয়া’ মা-বাবাদের উদ্দেশ্যে লিখছি। অন্যরা পড়ে দ্বিমত করা ছাড়া বেশি উপকার পাবেন না।

১. ভাষাগত পারদর্শিতা

আপনারা তো জানেনই, যেকোন ভাষায় পারদর্শিতা বলতে ৪টা জিনিসকে বুঝায়, পড়তে পারা, লিখতে পারা, শুনে বুঝা আর বলতে পারা।

বাংলা:

মাতৃভাষা। আপনি যদি নাও চান, তারপরও বাচ্চা বাংলা শিখে যাবে। সুতরাং বাংলা বলা-শোনা নিয়ে বেশি চিন্তা করার দরকার নেই। এমনি এমনিই শিখবে। তবে লেখা ও পড়া নিয়ে আপনাকে কাজ করতে হবে।

• সন্তানের সাথে ও সামনে বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলুন। করসি-খাইসি-করতেসো ইত্যাদি ট্রেন্ডি উচ্চারণ বাদ দিন। করেছি, গিয়েছি, করছো। বাজে বাংলা শেখাবেন না। কুষ্টিয়া বাড়ি হলেও, আমার ভাষায় কিছুটা পাবনার টোন আছে, ম্যালা কষ্টে বাসায় ভাষা কসরত করি। অবশ্য বাচ্চার মা বিশুদ্ধভাষী, ঐটুকুই ভরসা।

• সব বাচ্চা একই বয়সে কথা শেখে না। কথা ফুটতে দেরি হলেই মহাভারত ‘শুদ্ধ’ হবে না, রূপকথা রূপকথাই থাকবে। বরং যতদিন আধো আধো কথা বলে, শুনে আনন্দ নিন।

• বাচ্চার সাথে বেশি বেশি কথা বলুন। যৌথ পরিবারের বাচ্চা একক পরিবারের বাচ্চার চেয়ে দ্রুত কথা শেখে। কথা বলার লোক বেশি পায় বলে।

• বুয়ার ভাষা যখন মাতৃভাষা হয়, তখন আর কার কী করার আছে।

• আমার বাবা পয়লা স্লেটে, এরপর আমাকে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখিয়েছেন। বাসায় একটা ছোট ব্ল্যাকবোর্ড ছিল। হোয়াইট বোর্ড ভাল, ধূলামুক্ত। এতে অক্ষরের প্যাঁচগুলো সুন্দর হবে। কারণ মুছে মুছে লেখা অনুশীলনের সুযোগ থাকবে। এরপর দিবেন পেন্সিল। আমার বাবা একটা দারুণ কাজ করেছিলেন। পেন্সিলের পর বলপয়েন্ট না দিয়ে দিয়েছিলেন ফাউন্টেনপেন। আমার মনে আছে, প্রায়ই স্কুলড্রেসে কালি লাগায়ে আনতাম। এতে যেটা হবে। ফাউন্টেনপেন বা জেলপেনে লেখাগুলো ঝকঝকে হয়। সুন্দর করে লেখতে ইচ্ছে করে। দেখতেও সুন্দর লাগে, একটা সেলফ-মোটিভেশন কাজ করে। এরপর দিবেন বলপেন।

• বানান করে পড়তে শিখলে বাচ্চার জন্য গল্পের বই কিনে দিন, বয়স অনুপাতে। এতে করে সে পড়ে মজা পাবে, আরো পড়বে। মজার গল্প হলে একই বই বার বার পড়বে। শব্দগুলো পরিচিত হবে। এতে পড়া ঝরঝরা হবে। যেমন ধরেন আমার এই লেখাটা কিন্তু আপনি বানান করে পড়ছেন না। আপনি শব্দের দিকে তাকিয়েই বুঝে নিচ্ছেন শব্দটা। কারণ শব্দটা আপনার পরিচিত। এই ‘পরিচিত’ শব্দটা আপনার পরিচিত, তাই বানান করে পড়ার দরকার হয়নি। এভাবেই পড়া ঝরঝরা হবে। স্কুলের চেয়ে মাদরাসায় সুন্দর হাতের লেখা আর দ্রুতপঠনে বেশি জোর দেয়া হয়। মাদরাসার ছাত্রদের গড় হাতের লেখা জেনারেল ছাত্রদের গড় হাতের লেখার চেয়ে সুন্দর। এর একটা কারণ উস্তাদদের এই বিষয়ে আলাদা কেয়ার, আরেকটা কারণ ব্ল্যাকবোর্ডে অভ্যাস করানো। এজন্য প্রথম দু’এক ক্লাস মাদরাসায় পড়ানো একটা সুন্দর ডিসিশান (যদি আলিম না-ও বানাতে চান)।

আরবি:

দীনী কমিউনিটির জন্য অবশ্যই সন্তানের ‘সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ’ এর পছন্দ হওয়া উচিত আরবি। শুধু আখিরাতের জন্য কাজে আসবে তাই না, বরং মনে রাখবেন, আরবি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। ফলে তার ক্যারিয়ারেও এটা কাজে আসবে না, তা নয়। আমরা কিন্তু প্রি-প্রাইমারি মানে ক্লাস ওয়ানের আগের পড়াশুনা নিয়ে আলোচনা করছি।

• নিজে আরবি শিখতে পারেন। সন্তানকে শেখানোর জন্য।

সন্তানের সাথে আরবিতে কথা বলুন, টুকিটাকি। আরবিতে লেকচার দিতে বলা হয়নি। আমার ভায়রার বাচ্চাগুলো ৪/৫ বছর বয়েসে পটাপট আরবি বলে। এতো সুন্দর লাগে শুনতে—

– আবী উনজুর, নেমের। (বাবা দেখো, বাঘ)

– আইনা? (কোথায়)

– হুনাক (ঐখানে)

– আবী, আনা হুনা (বাবা, আমি এখানে)

এরকম ছোট ছোট কথাবার্তা। এখন অবশ্য আরও ভালো বলে।

• শব্দগুলো শেখান, আরবি ভোকাবুলারি বাড়িয়ে দেন। ভায়রার বাচ্চাগুলো যে শব্দের আরবি জানে না, মাঝখানে একটা বাংলা শব্দ চালিয়ে দেয়। হা হা, কিন্তু মা-খালাদের সাথে আরবিতেই কথা বলে কম-বেশ। হিম্মত করে শুরু করেন ইনশাআল্লাহ।

• ‘এসো আরবি শিখি’ বইটা একা একা পড়লেও বেশ বুঝা যায়, পড়েন আর বাচ্চার সাথে কথা চালান। না বুঝা জায়গা গুলো মার্ক করে কোন আলিম থেকে জেনে নিলেন। খুব সহজ।

• আমরা যেমন আগে বাংলা কথা শিখি, পরে গ্রামার শিখি। তেমন করে আগে আরবি কথা শিখিয়ে দেন। পরে মাদ্রাসায় গ্রামার শিখে নেবে।

• ৫ বছর বয়সে বাসায় আরবি টীচার রাখতে পারেন। জাস্ট নাজেরা পড়াবে, ১ বছর।

ইংরেজি:

ইংরেজি একটা সহজ ভাষা, তরল। খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না, বলে আমার মনে হয়। যদি জেনারেল শিক্ষাকেই পছন্দ করেন, তবে কারিকুলামের সাথে সাথেই শিখে যাবে কাজ চালানোর মত ইংরেজি। তবে প্রি-প্রাইমারি লেভেলে আপনাকে একটু কষ্ট করতে হবে। শুধু প্রি-প্রাইমারি না, প্রতি বছরই স্কুলের উপর নির্ভর না করে ইংরেজি গ্রামারের একটা অংশ, যেমন কোনো বছর টেন্স, কোনো বছর ভয়েস, এভাবে।

• যদি চান বাচ্চার সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হোক ইংরেজি। তাহলে ‘আরবি’ অনুচ্ছেদটায় ‘আরবি’ শব্দে ‘ইংরেজি’ বসিয়ে আবার পড়ুন। আর যদি চান থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হোক, তাহলে কারিকুলামের উপর ছেড়ে দেন, আর নিজে একটু একটু করে বসুন।

• আর যাঁরা সন্তানকে মাদরাসায় দিতে চান, তারা ইংরেজির আলাদা যত্ন নিবেন, যখন মাদরাসা বন্ধ থাকবে। ব্যস হয়ে গেলো।

এই সুযোগে নিজের ঢোল পিটিয়ে নিই। ঢোলের ব্যাকগ্রাউণ্ডে…

ক) প্রাইমারি স্কুলে একবার আমার স্যাররা আব্বাকে ডেকে আমার সব সাবজেক্টের খাতা দেখালেন। এটা দেখানোর জন্য যে, আপনার ছেলে কিছু জায়গায় নাম্বার কম পেলেও, কোন সাবজেক্টে কোন জায়গায় বানান ভুল নাই।

খ) স্কুল কলেজে বাংলা-ইংলিশ বানান প্রতিযোগিতায় প্রাইজ ছাড়া খুব কম ফিরতাম।

গ) আব্বুর কাছে শুনেছি, আমি-ছোটভাই-আমার বোন ৩ জনই ক্লাস ওয়ানে থাকতে পেপার পড়তাম ঝরঝরা।

ঘ) ক্লাস ৬ থেকে আর প্যারাগ্রাফ কিংবা রচনা মুখস্ত করতাম না। ইংলিশ ফ্রী হ্যান্ড প্যারাগ্রাফ-এসে, বাংলা রচনা লিখতাম বানিয়ে বানিয়ে।

যে কারণে নিজের ঢোলে এতগুলান বাড়ি দিলাম। অফিস শেষে আব্বু নিজে আমাদের ভাইবোনকে পড়াতেন। বাজারের ব্যাকরণ পড়াতেন না শুরুতে। একটা ডায়রিতে নিজে লিখে লিখে বই বানাতেন, আর নিজের টেকনিকে পড়াতেন। গ্রামার ধরার আগেই ভাষা ধরা শেষ, বানানের নিয়মকানুন বোঝা শেষ। এই বইগুলো চাইল্ড সাইকোলজির ‘থিওরি’ না, আব্বুর প্র্যাকটিক্যাল, যার প্রমাণ আমরা তিন ভাইবোন। বাংলা ইংরেজি দুটোতেই আব্বু নিজস্ব কৌশলে আমাদের গ্রহণক্ষমতা অনুযায়ী সাজিয়ে সাজিয়ে ডায়েরি লিখেছেন। যারা ‘এসো আরবি শিখি’ পড়েছেন, কিছুটা মিল খুঁজে পেয়েছি আমি কৌশলে।

ডায়রি দুটো বই আকারে আনার কাজ শুরু হয়েছে। তিন মাস তিন মাস ছয় মাসে আপনার সন্তানকে বই দুটো পড়িয়ে দিতে পারলে তার তাকাতে হবে না ইনশাআল্লাহ। সাথে দীনী ভাবধারা যোগ হচ্ছে বাচ্চাদের মত করে, থাকছে শিক্ষক নির্দেশনা, কিছু গ্রাফিক্সের কাজ। বাক্য রচনা বা ট্রান্সলেশনগুলোতে দীনী পরিচিতি আনা হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ। আমার বাচ্চাকে কী পড়াব টেনশানে ছিলাম। দুআ করবেন সবাই, যেন তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হয়।

২. বিশ্লেষণী ক্ষমতা

এটাই মূলত মানসিক দক্ষতার নির্দেশক। ISSB, BCS, IBA, ভার্সিটির কিছু কিছু ভর্তি পরীক্ষায় (IER ইত্যাদি) এই টেস্ট ব্যাপকভাবে নেয়া হয়। কয়েক ধরনের হয় এগুলো:

– জানা সূত্র থেকে অজানা কিছু বের করা

– জানা কিছু জিনিস থেকে সূত্র বের করে অজানা কিছু নির্ণয় করা

– মিল-অমিল বের করা

– ভাষার মারপ্যাঁচ বুঝা

– দেয়া তথ্য থেকে সমাধান বের করা

যদি পরিচিত শব্দে বুঝাতে চাই, ‘কিয়াস’ করার দক্ষতা। পশ্চিমা বিশ্বে পরীক্ষার সিস্টেমগুলো এরকমই বলে শুনেছি। ওদের অনুকরণেই আমাদের দেশে ‘সৃজনশীল’ নামে উদ্ভট এক জিনিস চালু হয়েছিল। নাম সৃজনশীল হলেও, প্রশ্নগুলো আর সৃজনশীল থাকেনি। দক্ষ প্রশ্নকারীর অভাবে সেই মুখস্ত প্রশ্নই চলে এসেছে ঘুরেফিরে।

এই ক্ষমতাটাই মানুষের এক্সক্লুসিভ ক্ষমতা, এজন্যই আমরা মানুষ। বানর-শিম্পাঞ্জীতে সামান্য কিছুটা পাওয়া যায়। আল্লাহ এই ক্ষমতাটা দিয়েই আমাদের টেস্ট নিচ্ছেন। সৃষ্টি দেখে স্রষ্টাকে চেনার পরীক্ষা। কিছু জানা জিনিস বিশ্লেষণ করে অজানা অদেখা বিষয় উপলব্ধি করে একটা সিদ্ধান্তে আসার পরীক্ষা।

• বাচ্চারা এগুলো কিছুটা নিজে নিজেই শিখে আর এপ্লাই করে। আপনি কিছু বস্তু সরবরাহ করবেন।

– যেমন, বিল্ডিং সেট। এগুলোর সাথে যে ছবিগুলো দেয়া থাকে, হুবহু অমন বানাতে বলবেন। পারলে পুরস্কার দিবেন। তাহলে ও মনে রাখবে, আরও মনোসংযোগ করবে।

– কিংবা ‘প্লেইং ডৌ’, বিভিন্ন কালারের আটার খামিরের মত পাওয়া যায়। বেশি ছোট বাচ্চাকে দিয়েন না, খেয়ে ফেলবে। এগুলো দিয়ে সাথে দেয়া ডিজাইনের মত বানাতে বলবেন। পুরস্কার দিতে ভুলবেন না।

• সম্পর্কগুলো বোঝে কি না। আমি তোমার বাবা, তোমার দাদা আমার বাবা। তোমার দাদী আমার মা। আবার তোমার দাদী তোমার ফুপিরও মা। তাহলে তুমি আর হামযা যেমন ভাইবোন, আমি আর তোমার ফুপিও ভাই-বোন।

• সিম্পল যোগবিয়োগ, কয়েন গোণা, কোন খাবার ভাগ করা। এই জাতীয় হাবিজাবি আর কি। এগুলো যত চর্চা করা হবে তত শাণিত হবে। বিশ্লেষণী ক্ষমতা বাড়বে।

• কোন কাজ একবার দেখিয়ে দিয়ে পরের বার তার হাতে ছেড়ে দেখবেন করতে পারছে কি না। যেমন একটা কেক ভাগ করা সমান ভাগে। কিছু একটা এঁকে তাকে আঁকতে বললেন।

বিবিধ:

আমার মনে আছে, আমি যখন ওয়ান বা টু- তে পড়ি, আব্বু আমাকে একটা ম্যাপের বই কিনে দিয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান প্রিন্ট। আর শিখিয়েছিলেন প্রণালী-মালভূমি-পর্বত-অন্তরীপ-দ্বীপ কাকে বলে। আমি খুব মজা নিয়ে দেখতাম, কত্তবড় দুনিয়া, কত্তবড় সাগর-মহাসাগর। ক্লাস ফাইভের দিকে আমাকে যে কোন দেশ বের করতে বললেই করে দিতাম, যেকোন পাহাড়-হ্রদ-প্রণালী-উপসাগর দেখিয়ে দিতাম, প্রায় অর্ধেকের বেশি দেশের রাজধানী মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল ম্যাপ দেখে দেখে। নিজের খুশিতে দেখতাম। আব্বু আমাকে কেবল মজাটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

আরেকটা জিনিস আব্বু করেছিলেন। বইয়ের সাথে ভালোবাসা তৈরি করে দিয়েছিলেন। তখন নওগাঁয় থাকতাম আমরা। অফিসের কাজে ঢাকা এলে ফেরার সময় আমার জন্য ২০-৩০ টা করে বই নিয়ে আসতেন। রূপকথা থেকে শুরু করে বিজ্ঞানবিষয়ক, ডাইনোসর, নানান দেশের লোককাহিনী, ইতিহাস, জীবনী, রহস্য, ধর্মীয়— সব। তবে কোনদিন কিনে দেননি কমিক্স আর বন্দুক-পিস্তল। সাথে করে নিয়ে জেলা বইমেলায় নিয়ে যেতেন, বই কিনে দিতেন। খাওয়ার সময়ও ঐসব বই পড়তাম।

ডায়েরি লেখার অভ্যাস করে দিয়েছিলেন। সম্ভবত ক্লাস থ্রি থেকে ডায়েরি লিখতাম। রোজনামচা ধরনের না, হাবিজাবি। পেপার, ম্যাগাজিন, বইয়ে ইন্টারেস্টিং কিছু পেলে টুকে রাখতাম। যেমন ধরেন, সেসময় ‘আকবর দি গ্রেট’ হত টিভিতে। মোঘল বাদশাহদের পুরো নাম বলত, মজা পেয়েছিলাম।

জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর

নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন

জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর

এরপর সিরিয়াল গেল বন্ধ হয়ে। বাকিগুলো কই পাই। বাসায় একটা বই ছিল ‘ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্যের ইতিহাস’। তখন এসব বই পড়ার আগ্রহ বা বুঝ কোনটাই ছিলনা। খুঁজে খুঁজে বাকি নামগুলো বের করে টুকে বই রেখে দিলাম বইয়ের জায়গায়।

নূরউদ্দিন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

শিহাবউদ্দিন মুহাম্মদ শাহজাহান

মহিউদ্দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব, খালাস।

আমাদের তিন ভাইবোনেরই ডায়েরি লেখার অভ্যাস করেছিলেন আব্বু। এখনকার বাচ্চারা সময়ই পায় না দম ফেলার। বাচ্চাকে দম নেবার সময় দিয়েন। ওর নিজের মত কিছু সময়। আর কিছু না হলেও খেলার সময়টুকু ম্যানেজ করে দিয়েন। গা ঘামিয়ে খেলা। জায়গা না থাকলে ব্যাডমিন্টন বা টেবিল টেনিস ভালো অপশান। বিশেষ করে টেবিল টেনিস তো খুবই ভালো অপশান।

আর ওর কলিজাটা বড় করে দিবেন। দুনিয়াটা বিশাল করে দিবেন। তোমাকে এটাই হতে হবে, এটাই করতে হবে। এভাবে আটকে দিবেন না। আমার মনে আছে, আব্বু আমাকে বলতেন, থ্রি বা ফোরে পড়ি তখন। একটা বাগান ছিল, বাগানে আব্বুর সাথে কাজ করতাম। টমেটো, লালশাক, কুমড়ো লাগাতেন। আব্বু বলতেন, নোবেল প্রাইজ তো মানুষেই পায়, তুমিও পেতে পারো। বিশ্বাস করবেন না, মেডিকেলে ভর্তির আগ পর্যন্ত আমার মধ্যে এটা কাজ করত। ওটা তো মানুষেই পায়, আমিও পেতে পারি। তবে তখন আমাদের দীনের বুঝ ছিল না। এখন আমার সন্তানদের টার্গেট হল, তোমরা ‘সাহাবী’ হবে। ওনারা পানির উপর ঘোড়া চালিয়ে পার হয়েছেন, তোমরাও পারবে। আম্মাজান আয়িশা রা. এর মত বড় ফকীহ হবে। খালিদ রা. এর মত সমরবিদ হবে। সাহাবীরা যেমন নবীজীর অনুকরণ করেছেন, ওনারাও মানুষ, পেরেছেন, তোমরাও পারবে। মানুষই পারে। কলিজা বড় করে দিব, তবে ফোকাস থাকবে আখিরাত।

আরও কিছু জিনিস শেখাতে ভুলবেন না। সাঁতার আর সাইকেল চালানো। শিশু শ্রেণীতে আব্বু আমাকে একক-দশক-শতক-হাজার-অযুত-লক্ষ-নিযুত-কোটি শিখিয়েছিলেন। মেঝেতে গোল করে চারপাশ দিয়ে চক দিয়ে লিখতেন এগুলো। আর আমার একটা খেলনা মটর সাইকেল ছিল, একটু যেত, আবার পিছে আসত, আবার যেত। ঐ খেলনাটা মাঝে রাখতেন। মটরসাইকেল যেখানে গিয়ে থামত, বলো এটা কি? সোল্লাসে বলতাম একোওওওক, অযুউউউত। আপনাকে গবেষক হতে হবে। বাচ্চাকে বাচ্চা হয়ে শেখাতে হবে। শেখানোর টেকনিক বের করতে হবে। আনন্দ তৈরি করে দিতে হবে। এটা স্কুল-কলেজের ব্যবসায়ীরা করবে না। আপনি বাবা, আপনি করবেন।

আর সন্তানকে অভিশাপ দেবেন না, ডিমরালাইজ করবেন না। তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না— এসব বলবেন না। দুআ করবেন, পিতামাতার দুআ সন্তানের জন্য কবুল। ২০০৭ সালে আব্বু-আম্মু হজ্জ করে আসেন। আমি তখন কষে ছাত্রলীগ করি। বাবা-মাকে পেরেশান করার জন্য একটা ছেলে যা যা করতে পারে, প্রায় সবই করি। আমাকে প্রতিদিন নামাযের কথা বলতেন দু’জনে। একদিন খুব করে বললেন নামায না পড়ার জন্য। রেগে মেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম, চলে গেলাম হোস্টেলে। কয়েকদিন আর ওমুখো হলাম না। আমি কি বুঝি না, কাদের দুআ আমাকে আজ এত সুন্দর একটা জীবন দিয়েছে? রাব্বিরহামহুমা কামা রব্বাইয়ানী সাগীরা।

এখন আমি টের পাই, ‘বাবা’ (জনক না কেবল) হবার মধ্যে কী সুখ। নোবেল প্রাইজ পাবার সুখ কি আরো বেশি? হলে হোক, আমার তাতে কী? 

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *