নামায শেষে মস‌জি‌দ থে‌কে বে‌রি‌য়ে যাওয়া কি জরু‌রি?

এক‌টি আয়া‌তের ভুল তাফসীর :

এক‌টি আয়া‌তের ভুল ব্যাখ্যা শুন‌তে শুন‌তে ক্লান্ত হ‌য়ে প‌ড়ে‌ছি। দাওয়াত ও তাবলী‌গের মস‌জিদ‌কে‌ন্দ্রিক মেহনত ‌দে‌খে এবং মস‌জিদ‌বিমুখ মানুষ‌দের মসজিদমু‌খি করতে দে‌খে কিছু ভাই‌কে খুবই না‌খোশ ব‌লে ম‌নে হয়! তাদের ম‌ধ্যে কিছু লোক তো মু‌খের ওপরই ব‌লে ও‌ঠে, এবং সাথী‌দের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা ক‌রে এই ব‌লে- “মস‌জি‌দে ব‌সে থাকা তোমরা কোথায় পে‌য়ে‌ছো? নামায প‌ড়ে মস‌জি‌দে বস‌ে থাক‌তে কে ব‌লে‌ছে? আল্লাহ তো নামায শে‌ষ ক‌রে জ‌মি‌নে ছ‌ড়ি‌য়ে পড়‌তে আ‌দেশ করে‌ছেন!” ইত্য‌া‌দি ইত্যা‌দি!
সব‌চে দুঃখজনক ব্যাপার হ‌লো, বহু নামকরা বক্তা, ‘স্কলার’, লেখকও এ আয়াত ব্যবহার ক‌রে মানুষ‌কে এ জা‌তীয় কথা ব‌লে লোক‌দের বিভ্রান্ত ক‌রতে দেখা‌ গে‌ছে। এ‌টি কি তা‌দের অজ্ঞতা না‌কি জ্ঞানপাপ, বিষয়‌টি আমার কা‌ছে প‌রিস্কার নয়?
তারা এ‌ক্ষে‌ত্রে সূরা জুমুআর ১০নং আয়াত পাঠ ক‌রে শোনান। সাধারণ মানুষ তো কুরআন শু‌নে বিগ‌লিত হ‌য়ে যায় ও আত্মসমর্পণ ক‌রতে বাধ্য হয়। বিগ‌লিত হওয়া উ‌চিৎ; কারণ‌ এ‌টি ঈমা‌নের লক্ষণ। কিন্তু আয়াত‌টির এমন অপপ্র‌য়োগ ও অপব্যাখ্যা দে‌খে খুবই মর্মাহত হই। আমি ম‌নে ক‌রি, “লাকুম দীনুকুম ওয়া লিয়া দীন” ব‌লে ধর্ম‌নির‌পেক্ষতা প্রমা‌ণের অপ‌চেষ্টা করা, আর সুরা জুমআর ১০ নং আয়াত ব‌লে নামায শে‌ষে মস‌জিদে অবস্থান করা‌কে অপরাধ সাব্যস্ত করার ম‌ধ্যে কো‌নো তফাৎ নেই। উভয়পক্ষ্য মারাত্মক ভ্রা‌ন্তি‌তে র‌য়ে‌ছে।
আসুন, সে‌টি কী ভা‌বে, জে‌নে নেই!

সুরা জুমআর ৯-১০ আয়াত ও তার অনুবাদ

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا نُوۡدِیَ لِلصَّلٰوۃِ مِنۡ یَّوۡمِ الۡجُمُعَۃِ فَاسۡعَوۡا اِلٰی ذِکۡرِ اللّٰہِ وَ ذَرُوا الۡبَیۡعَ ؕ ذٰلِکُمۡ خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۹﴾
فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوۃُ فَانۡتَشِرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَ ابۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِ اللّٰہِ وَ اذۡکُرُوا اللّٰہَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ ﴿۱۰﴾
“হে ঈমানদারগণ ! জুমু’আর দিনে যখন সালাতের জন্য ডাকা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং কেনা-বেচা ত্যাগ কর, এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, যদি তোমরা জানতে।
অতঃপর সালাত শেষ হলে তোমরা যমীনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর ও আল্লাহকে খুব বেশী স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।”

আয়াত না‌যি‌লের প্রেক্ষাপট :

মদীনা শরী‌ফে তখন খুব অভাব চল‌ছিল। অ‌নেক‌দিন থে‌কে আমদানী-রপ্তানী বন্ধ। একবার জুমআর দি‌নে নবী‌জি সা. জুমুআর খোতবা দি‌চ্ছিলেন। এমন সময় মদীনার এক ব্যবসায়ী কা‌ফেলা ‌ফি‌রে এ‌লো। এ সংবাদ জ‌নৈক অমুস‌লিম ঢোলতবলা বা‌জি‌য়ে চাউর ক‌রে দি‌লো। ফ‌লে বহু লোক নবী‌জি সা.‌কে খোৎবায় রে‌খেই ব্যবসায়ী কা‌ফেলা দেখ‌তে চ‌লে গেল। মাত্র অল্প ক’জন মুসল্লী মস‌জি‌দে র‌য়ে গেল। বিষয়‌টি আপ‌ত্তিকর ও সংশোধন‌যোগ্য ছিল। এ প্রে‌ক্ষি‌তে উপরুক্ত আয়াতগু‌লো না‌যিল হয়ে‌ছিল। (ইবনু কাসীর)

আয়া‌ত থে‌কে প্রাপ্ত শিক্ষা

*জুমআর আযা‌নের পর ব্যবসা বা‌নিজ্য ও বেচা‌কেনা করা নি‌ষেধ।
*আযা‌নের পর মস‌জি‌দে যাওয়ার প্রস্তু‌তি নেওয়া জরু‌রি।
*নামায ও খোতবা রে‌খে পা‌র্থিব কা‌জে মশগুল থাকা যা‌বে না।
*প্র‌য়োজনীয় জাগ‌তিক কাজ নামা‌যের সময় নয়, বরং নামা‌যের প‌রে কর‌বে। (তাফসীর গ্রন্থসমূহ)

আয়াতদ্ব‌য়ের অপব্যাখ্যা ও ভুল তাফসীর

আয়াত না‌যি‌লের প্রেক্ষাপট ও আয়া‌তের তরজমা থে‌কেই সুধি পাঠক বুঝ‌তে সক্ষম হ‌য়ে‌ছেন, এ আয়াতদ্ব‌য়ের দা‌বি কী? দাবী একটাই, নামায রে‌খে দু‌নিয়াবী কাজ করা যা‌বে না। দু‌নিয়াবী কাজ নামা‌যের শে‌ষেই কর‌বে। এতটুকুই!
‌কিন্তু এখা‌নে ‘নামায শে‌ষে মস‌জি‌দে অবস্থান করা আপ‌ত্তিকর এবং বে‌রি‌য়ে যাওয়‌া বাধ্যতামূলক’ এ ব্যাখ্যা তারা কোথায় পে‌লেন? এটা না কো‌নো তাফসীরগ্র‌ন্থে আ‌ছে, না কো‌নো হাদীস দ্বারা প্রমা‌ণিত, না শরীয়‌তের কো‌নো উসূল দ্বারা প্রমাণ করা যা‌বে।
বরং শরীয়‌তের স্বীকৃত উসূল হ‌লো :
কো‌নো নাহী বা নি‌ষেধাজ্ঞার প‌রে য‌দি ‘আমর’ তথা আজ্ঞাসূচক শব্দ আ‌সে, সেটা কেবল বৈধতা ও অনুম‌তি প্রদানের জন্য আ‌সে, নি‌র্দে‌শের জন্য নয়। অর্থাৎ, পূ‌র্বোক্ত নি‌ষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হ‌য়ে‌ছে, সেটা বুঝা‌তে সেখা‌নে ‘আমর’ বা আজ্ঞাসূচক শব্দ ব্যবহার করা হ‌য়ে থা‌কে।
৯নং আয়াত দ্বারা জুমআর নামা‌যের সময় বেচা‌কেনা‌ ও তিজার‌তে নি‌ষেধাজ্ঞা আ‌রো‌পিত হ‌য়ে‌ছে। তা হ‌লে মানুষ তার প্র‌য়োজনীয় আয়‌-রোজকার কখন কর‌বে? ১০নং আয়া‌তে নামা‌যের পরের সময় থে‌কে সে নি‌ষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হ‌য়ে‌ছে এবং বলা হ‌য়ে‌ছে : যখন নামায পূর্ণ হ‌বে, তখন তোমরা যমী‌নে ছ‌ড়ি‌য়ে পড় এবং আল্লাহর ফযল অনুসন্ধান কর।
প্রিয় পাঠক, বিষয়‌টি আশাক‌রি প‌রিস্কার হ‌য়ে‌ছে। বিশ্বাস না হয়, তো তাফসীর গ্রন্থগু‌লো খুলুন।
ইমাম কুরতুবী রহ. লি‌খে‌ছেন :
هذا أمر إباحة ، كقوله تعالى وإذا حللتم فاصطادوا (المائدة ٢)
“এ‌টি অনু‌মোদনসূচক আজ্ঞা। এর উদাহরণ হ‌লো, ইহরাম প‌রিধানকারী‌দের প্র‌তি আ‌দে‌শের ম‌তো : “যখন তোমরা হালাল হ‌য়ে যা‌বে, তখন তোমরা শিকার কর।” (সূরা মা‌য়েদা : ২)
হাজী সা‌হেব যেমন হালাল হওয়ার প‌রে পশুপা‌খি শিকার কর‌তে বাধ্য নয়, এ‌টি কেবল অনু‌মোদনমাত্র, তেম‌নি নামায আদায়কারী নামায শে‌ষে রু‌জি‌তে বে‌রি‌য়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়, স্রেফ অনু‌মোদন মাত্র। ই‌চ্ছে হলে যে‌তে পা‌রে, ই‌চ্ছে হ‌লে মস‌জি‌দে অবস্থান কর‌তে পা‌রে।
ইবনু কাসীর রহ. লি‌খে‌ছেন :
لما حجرهم فى التصرف بعد النداء وأمرهم بالاجتماع أذن لهم بعد الفراغ في الانتشار في الأرض والابتغاء من فضل الله.
“যখন তা‌দের‌কে আযা‌নের পর লেন‌দেন কর‌তে বারণ করা হ‌য়ে‌ছে এবং মস‌জি‌দে এক‌ত্রিত হ‌তে আ‌দেশ করা হ‌য়ে‌ছে; এবার তা‌দের‌কে নামায থে‌কে অবসর হওয়ার পর যমী‌নে ছ‌ড়ি‌য়ে পড়‌তে এবং আল্লাহর ফযল তালাশ কর‌তে অনুম‌তি দেওয়া হ‌য়ে‌ছে।”
সুতরাং বুঝা গে‌লো নামা‌যের পর আয়‌-রোজকা‌রে যাওয়া ঐ‌চ্ছিক বিষয়, বাধ্যতামূলক নয়। এক‌টি ঐ‌চ্ছিক বিষ‌য়কে উক্ত আয়াত দ্বারা বাধ্যতামূলক প্রমাণ করা তার অপব্যাখ্যা ও ভুল তাফসীর।
বি‌শেষ ক‌রে মানুষ যখন মস‌জি‌দের ম‌তো পবিত্র স্থা‌নে অবস্থানের ইচ্ছা‌পোষণ কর‌ছে এবং সেখা‌নে জরু‌রি দীনী কা‌জে কর‌তে চাইছে, অপর দি‌কে তার আর আয়‌-রোজকারের তেমন প্র‌য়োজন নেই, বাই‌রেও সাংসা‌রিক কো‌নো জরুর‌ী কাজ নেই; সেখা‌নে তা‌কে মস‌জিদ থে‌কে বের করার জন্য আয়াত‌কে হা‌তিয়ার হিসা‌বে ব্যবহার জঘন্য খেয়ানত।
‌বিষয়‌টি আরও প‌রিস্কার হ‌বে, য‌দি নামা‌যের পর পরবর্তী নামা‌যের অ‌পেক্ষায় মস‌জি‌দে ব‌সে থাকা এবং মস‌জি‌দে গমন ও অবস্থা‌নের হাদীসগু‌লোর প্র‌তি আমরা লক্ষ ক‌রি। এ অধ্যা‌য়ে অসংখ্য হাদীস বিদ্যমান। আমরা মাত্র ক‌য়েক‌টি হাদীস উদাহরণ স্বরূপ‌ পেশ কর‌ছি।

এক নামায শে‌ষে পরবর্তী নামা‌যের অ‌পেক্ষায় ব‌সে থাকার ফ‌যীলত

(১)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ “‏ الْمَلاَئِكَةُ تُصَلِّي عَلَى أَحَدِكُمْ مَا دَامَ فِي مُصَلاَّهُ مَا لَمْ يُحْدِثْ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ، اللَّهُمَّ ارْحَمْهُ‏.‏ لاَ يَزَالُ أَحَدُكُمْ فِي صَلاَةٍ مَا دَامَتِ الصَّلاَةُ تَحْبِسُهُ، لاَ يَمْنَعُهُ أَنْ يَنْقَلِبَ إِلَى أَهْلِهِ إِلاَّ الصَّلاَةُ ‏”‏‏.‏
“আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত :
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তোমাদের কেউ যতক্ষণ তার নামা‌যের স্থানে থাকে, উযূ ভঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত তার জন্য ফে‌রেশতাগণ এ বলে দু‘আ করে যে, হে আল্লাহ্! আপনি তাকে ক্ষমা করে দিন, হে আল্লাহ! আপনি তার উপর রহম করুন। আর তোমাদের মাঝে যে ব্যক্তির সালাতই তাকে বাড়ি ফিরে যাওয়া হতে বিরত রাখে, সে সালাতে রত আছে বলে পরিগণিত হবে।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৬৫৯, হাদিসের মান: সহীহ)
(২)
حَدَّثَنَا آدَمُ بْنُ أَبِي إِيَاسٍ، قَالَ حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي ذِئْبٍ، عَنْ سَعِيدٍ الْمَقْبُرِيِّ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ لاَ يَزَالُ الْعَبْدُ فِي صَلاَةٍ مَا كَانَ فِي الْمَسْجِدِ يَنْتَظِرُ الصَّلاَةَ، مَا لَمْ يُحْدِثْ ‏”‏‏.‏ فَقَالَ رَجُلٌ أَعْجَمِيٌّ مَا الْحَدَثُ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ قَالَ الصَّوْتُ‏.‏ يَعْنِي الضَّرْطَةَ‏.‏
আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত : আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : বান্দা যে সময়টা মসজিদে সালাতের অপেক্ষায় থাকে, তার সে পুরো সময়টাই সালাতের মধ্যে গণ্য হয় যতক্ষণ না সে হাদাস করে। জনৈক অনারব বলল, হে আবূ হুরায়রা ! ‘হাদাস কি?’ তিনি বললেন, ‘শব্দ করে বায়ু বের হওয়া।’ (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৭৬, হাদীসের মান: সহিহ)
(৩) আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত :
রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আমি কি তোমাদের এমন কাজ জানাবো না, যা করলে আল্লাহ বান্দার পাপরাশি দূর করে দেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করেন? লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি বলুন। তিনি বললেন : অসুবিধা ও কষ্ট সত্ত্বেও পরিপূর্ণরূপে ওযূ করা, মসজিদে আসার জন্যে বেশি পদচারণা করা এবং এক সালাতের পর আর এক সালাতের জন্যে প্রতীক্ষা করা; আর এ কাজগুলোই হল সীমান্ত প্রহরা (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ৪৭৫, হাদিসের মান: সহীহ)
(৪)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : ” مُنْتَظِرُ الصَّلَاةِ مِنْ بَعْدِ الصَّلَاةِ كَفَارِسٍ اشْتَدَّ بِهِ فَرَسُهُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ عَلَى كَشْحِهِ تُصَلِّي عَلَيْهِ مَلَائِكَةُ اللَّهِ مَا لَمْ يُحْدِثْ أَوْ يَقُومَ، وَهُوَ فِي الرِّبَاطِ الْأَكْبَرِ “. حكم الحديث: إسناده حسن.
“হযরত আবু হুরাইরা রা‌যি. হ‌তে ব‌র্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ ক‌রেন : নামা‌যের পর নামাযের অ‌পেক্ষায়রত ব্য‌ক্তি ওই অশ্বা‌রোহীর ম‌তো, যা‌কে তার অশ্ব তীব্র‌ বে‌গে হা‌কি‌য়ে নি‌চ্ছে। আর সে বড় সীমান্ত প্রহরায় র‌য়ে‌ছে।” (মুসনা‌দে আহমাদ হাদীস নং ৮৬২৫, হাদী‌সের মান হাসান)
এ ম‌র্মের বহু হাদীস র‌য়ে‌ছে হাদীসগ্রন্থ সমূ‌হে; যা স্পষ্ট প্রমাণ ক‌রে নামা‌যের পর মস‌জি‌দে অবস্থান করা নিন্দনীয় তো নয়, বরং বহু মর্যাদাপূর্ণ ও অ‌নেক সওয়া‌বের আমল।
শুধু তাই নয়, মস‌জি‌দে অবস্থান করা স্বতন্ত্র এক‌টি ইবাদত। এর দ্বারা অবস্থানকারী আল্লাহর‌ খাস বান্দায় প‌রিণত হয়। খোদ মস‌জি‌দই তো নি‌র্মিত হ‌য়ে‌ছে সেখা‌নে অবস্থা‌নের জন্য, যা‌কে প‌রিভাষায় ই’‌তিকাফ ব‌লে। কুরআ‌নের ইরশাদ :
وَ عَہِدۡنَاۤ اِلٰۤی اِبۡرٰہٖمَ وَ اِسۡمٰعِیۡلَ اَنۡ طَہِّرَا بَیۡتِیَ لِلطَّآئِفِیۡنَ وَ الۡعٰکِفِیۡنَ وَ الرُّکَّعِ السُّجُوۡدِ
“আর‌ আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈল থে‌কে অঙ্গীকার নি‌য়ে‌ছি, তোমরা উভ‌য়ে আমার ঘর‌কে তাওয়াফকারী, অবস্থানকারী ও নামায আদায়কারী‌দের জন্য প‌বিত্র রাখবে।” (সূরা বাকারা : ১২৫)
হাদীস শরী‌ফেও মস‌জি‌দের সা‌থে আ‌ত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করা, সেখা‌নে যাতায়াত করা ও অবস্থান করা‌কে নানাভা‌বে উৎসা‌হিত করা হ‌য়েছে। ক‌য়েক‌টি উদাহরণ :

মস‌জি‌দে অবস্থা‌নের ফযীলত

(১) সাত ব্য‌ক্তি‌কে আল্লাহ তাআলা আর‌শের ছায়ায় ছায়া দি‌বেন। তন্ম‌ধ্যে ওই ব্য‌ক্তিও র‌য়ে‌ছে, “যার অন্তর মস‌জিদের সা‌থে ঝু‌লে থা‌কে।” (বুখারী : ৬৬০)
(২) নবী‌জি সা. ইরশাদ ক‌রে‌ছেন, যখন তোমরা কাউ‌কে মস‌জি‌দে যে‌তে অভ্যস্ত দে‌খ, তা‌কে মু‌মিন ব‌লে স্বাক্ষ্য দি‌তে পার। (তির‌মিযী : ২৬১৭)
(৩) নবী‌জি সা. ইরশাদ ক‌রে‌ছেন, যে ব্য‌ক্তি নামায ও যিক‌রের জন্য মস‌জিদ‌কে গৃহ বানায়, আল্লাহ তাআলা সে ব্য‌ক্তির ওপর এমন খু‌শি হন, যেমন দীর্ঘ দিন অনুপ‌স্থিত ব্য‌ক্তি নিজ গৃ‌হে ফি‌রে এলে ঘরওয়ালারা খু‌শি হয়। (ইবনু মাজাহ : ৮০০)
(৪) নবী‌জি সা. ইরশাদ ক‌রে‌ছেন : নিশ্চয় মস‌জিদ আবাদ কারীরা আল্লাহর আপনজন।” (তারগীব লিলমুন‌যিরী : ৪৯০)
(৫) যে মস‌জিদ‌কে ভা‌লোবা‌সে, আল্লাহ তা‌কে ভা‌লোবা‌সেন।” (তারগীব : ৪৯১)
এটা তো গেল মস‌জি‌দে সাধারণ গম‌নের ফযীলত।
য‌দি কেউ তা’লীম, যি‌কির, মুযাকারা, দীনী আ‌লোচনা, পরামর্শ তথা দীন যিন্দা করার কা‌জে সেখা‌নে গমন ক‌রে, তা হ‌লে তো ফযীলত বহুগুণ বে‌ড়ে যা‌বে। এতদসংক্রান্ত হাদীসগু‌লো তার প্রমাণ। যেমন হাদী‌সে ব‌র্ণিত হ‌য়ে‌ছে :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : ” مَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللَّهِ تَعَالَى، يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلَّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ، وَحَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ “.
আল্লাহর ঘর সমূহ থে‌কে কো‌নো ঘ‌রে যখন কো‌নো সম্প্রদায় এক‌ত্রিত হয়, আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত ক‌রে এবং পরস্পর তার পঠনপাঠ‌নে ‌লিপ্ত থা‌কে, তা‌দের ওপর সকীনা না‌যিল হয়, রহমত তা‌দের ঢে‌কে নেয়, ফে‌রেশতারা বেষ্টন ক‌রে নেয় এবং আল্লাহ তাআলা নিকটবর্তী ফে‌রেশতা‌দের সা‌থে তার কথা আ‌লোচনা ক‌রেন। (সুনান আবু দাঊদ : ১৪৫৫)
আ‌রো এক‌টি‌ ভুল ব্যাখ্যা : ———————–
এখা‌নে আ‌রেক‌টি ভুল তাফসীর করা হয় ابۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِ اللّٰہِ এর তাফসী‌রে কর‌তে গি‌য়ে। তাঁরা এর কেবল রি‌যিক তালা‌শের অর্থ ক‌রেই ক্ষ্যান্ত হয়। অথচ এ‌টি মাত্র এক‌টি ব্যাখ্যা। মুফাস‌সিরীন এর আরও অ‌নেক ব্যাখ্যা লি‌খে‌ছেন। ‌কেউ ব‌লে‌ছেন, এর‌ অর্থ নফল নামায পড়‌া। কেউ ব‌লে‌ছেন ইলম তালাশ করা, ইব‌নে আব্বাস রা‌যি. ব‌লে‌ছেন, ‘এখা‌নে দু‌নিয়ার কো‌নো বিষয় তালাশ কর‌তে আ‌দেশ দেওয়া হয়‌নি; বরং রুগী দেখা, মুসলমান ভাই‌দের সা‌থে সাক্ষাত করা, জানাযায় শরীক হওয়ার কথা বলা হ‌য়ে‌ছে।’ (কুরতুবী)
কা‌জেই এক‌টি বিষ‌য়ের সা‌থে ব্যাখ্যা‌কে সীমাবদ্ধ করা উ‌চিত নয়।
ত‌বে যে কা‌জের জন্যই বের হোক না কেন, সে যেন আল্লাহ‌কে না ভু‌লে। বাই‌রের কা‌জে এতটা মগ্ন না হ‌য়ে পড়া যে, আবার সে মস‌জি‌দে আস‌তে ভু‌লে যায়। বরং বাই‌রেও তা‌ঁকে যে স্মরণ ক‌রে এবং বে‌শি বে‌শি যি‌কির ক‌রে। এ‌তেই তা‌দের সফলতা। ইরশাদ হ‌য়ে‌ছে :
وَ اذۡکُرُوا اللّٰہَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ ﴿۱۰﴾
‌কিন্তু আমরা মস‌জিদ থে‌কে রু‌জির জন্য বের হওয়ার কথা বল‌লেও যি‌কি‌রের কথা কি ব‌লি?

কখন মস‌জিদ ছে‌ড়ে বাই‌রে যা‌বেন?

উপরুক্ত আ‌লোচনা দ্বারা প্রমা‌ণিত হলো, আয়াত‌টি‌তে নামায শে‌ষে মস‌জি‌দ থে‌কে বের হওয়া‌কে বাধ্যতামূলক করা হয়‌নি; বরং এ‌টি কেবল জা‌য়িয কাজ। বাই‌রে জরু‌রি কাজ থাক‌লে সে যে‌তে পা‌রে, নতুবা মস‌জি‌দেই অবস্থান কর‌বে এবং‌ উপরুক্ত ফযীলতগু‌লো হা‌সিল কর‌বে।
ত‌বে স্মরণ রাখ‌তে হ‌বে, মস‌জি‌দে অবস্থান করা‌কে সাংসা‌রিক কাজকর্ম ও জাগ‌তিক দা‌য়িত্বাবলী থে‌কে পলায়‌নের বাহানা বানা‌নো যা‌বে না। যদি কেউ কো‌নো প্র‌তিষ্ঠা‌নের বেতনভুক্ত কর্মচারী হ‌য়, মস‌জি‌দের বাই‌রে তার অন্য কো‌নো দীনী বা দু‌নিয়াবী জা‌য়িয ক‌র্মের দা‌য়িত্বশীল হয়ে থাকে, য‌দি কারও সাংসা‌রিক কাজকর্ম লেখাপড়া থা‌কে, য‌দি রু‌গির সেবাসুশ্রূষার জিম্মাদারী তার ওপর ন্যস্ত থা‌কে; অর্থাৎ এমন কো‌নো পা‌র্থিব বা ধর্মীয় কাজ থা‌কে যা মস‌জিদ থে‌কে বের হওয়া ছাড়া সম্ভব নয়; এমতাবস্থায় সে অবশ্যই মস‌জি‌দ থে‌কে বের হ‌বে। এ‌টি অবস্থা‌ভে‌দে কখ‌নো ওয়া‌জিব, কখ‌নো সুন্নত, কখ‌নো মুস্তাহা‌বে প‌রিণত হয়। কিন্তু সাধারণ অবস্থায় এ‌টি কেবল জা‌য়িয থা‌কে, যে সূরা জুমআর দশম আয়াত দ্বারা ই‌তিপূ‌র্বে প্রমা‌ণিত হ‌য়ে‌ছে।

মস‌জিদ থে‌কে বের হওয়ার পূ‌র্বে ভাবুন

‌কিন্তু যখন মস‌জি‌দের বাই‌রে এমন কো‌নো জর‌ু‌রি কাজ না থা‌কে, তা হ‌লে আপ‌নি অন্তত একবার ভাবুন কেন আপ‌নি বের হচ্ছেন? আ‌গে চিন্তা কর‌ুন, এখান থে‌কে বের হওয়ার পর আপ‌নি কী কর‌বেন? আপনার মূল্যবান সময়গু‌লো দোকানপা‌টে কিংবা বন্ধু‌দের আড্ডায় শেষ হ‌য়ে যা‌বে না তো? কো‌নো গোনাহ আপনা‌কে পাকড়াও কর‌বে না তো? এখান থে‌কে গি‌য়ে টে‌লি‌ভিশ‌নের সাম‌নের ব‌সে যা‌বেন না তো? ‌মোবাইল নি‌য়ে ব্যস্ত হ‌য়ে পড়বেন না তো? পরবর্তী নামায আপনার ছু‌টে যাওয়ার ঝুঁ‌কি নেই তো?
আস‌লে এ আয়াত প‌ড়ে এমন এক জা‌তি‌কে মস‌জিদ‌বিমুখ করা হচ্ছে, যারা ফরয নামায ও ওয়া‌জিব জামাআ‌তে ঠিকমত শরীক হয় না। জুমআর দিন ছাড়া তা‌দের মস‌জি‌দে দেখা যায় না। যারা মস‌জিদ থে‌কে বের হ‌লে গোনাহর পর গোনা‌হে লিপ্ত হ‌বে। গান-বাজনা বা বেগানা নারী দর্শ‌নে লিপ্ত হ‌য়ে পড়‌বে। অ‌হেতুক খেল-তামাশায় ডু‌বে যা‌বে। হয়‌তো পরবর্তী নামাযও তার ছু‌টে যা‌বে তার।
এ ভুল ব্যাখ্যাকারীরা ভু‌লে গে‌ছে, মস‌জি‌দে অবস্থান উম্ম‌তের সমস্যা নয়; বরং মস‌জিদ‌বিমু‌খিতাই উম্মত ব‌খে যাওয়ার মুল কারণ। মুসলমান‌দের সং‌শোধ‌নের জন্য জা‌তি‌কে গণসং‌শোধন‌কেন্দ্র মস‌জি‌দে অবশ্যই ফেরা‌তে হ‌বে। যারা এ মহান কা‌জে রত র‌য়ে‌ছেন তা‌দের কৃতজ্ঞতা ও সাধুবাদ জানা‌তে হ‌বে এবং পূর্ণাঙ্গ সহ‌যো‌গিতা কর‌তে হবে।

অজা‌ন্তে আপ‌নি মস‌জিদ বিরানকারী হচ্ছেন না তো?

‌মোটকথা, মস‌জি‌দে অবস্থান করা, নামা‌যের পর আ‌রেক নামা‌যের অ‌পেক্ষায় থাকা, মস‌জি‌দে দীনী কাজকর্ম করা এক‌টি প্রশংসনীয় কাজ। মস‌জিদ তো কেবল পাঁচ ওয়াক্ত নামা‌যের জন্য নয়। বরং ইসলা‌মের স্বর্ণযু‌গে সেখা‌নে তা’লীম, তার‌বিয়া, বয়ান, মুযাকারা, মুশাওয়ারা, বিচার, দাওয়াত ও জিহা‌দের জন্য কা‌ফেলা পাঠা‌নো সবই সেখা‌নে হ‌তো। আজ কেবল শুধু নামাযই বা‌কি র‌য়ে‌ছে। আলহামদু‌লিল্লাহ দাওয়াত ও তাবলী‌গের মেহন‌তের ওসীলায় ধী‌রে ধী‌রে অ‌নেকগু‌লো কাজ মসজিদে ফি‌রে আস‌তে শুরু ক‌রে‌ছে। কিন্তু আমা‌দের ক‌তেক ভাই তার কৃতজ্ঞতা তো দূ‌রের কথা, বরং বি‌দ্বেষ বা অজ্ঞতার কার‌ণে অ‌হেতুক ছিদ্রান্বষ‌ণে লিপ্ত। এটি যে মস‌জিদ আবা‌দের ম‌তো এক‌টি ম‌হিমান্বিত কাজের অংশ, যা মুসলমান‌দের এক গুরু দা‌য়িত্ব; তা অ‌নেক মুসলমান ভু‌লেই গে‌ছে। অথচ আল্লাহ তাআলা মস‌জিদ আবাদকারী‌দের মু‌মিন ও হেদায়াত প্রাপ্ত ব‌লে উ‌ল্লেখ ক‌রে‌ছেন। (সূরা তাওবা) এক‌টি অনুভূ‌তিহীন খড়কু‌টোও মস‌জি‌দে অবস্থা‌নের গুরুত্ব বো‌ঝে। তা‌কে যখন কু‌ড়ি‌য়ে বের ক‌রে দেওয়া হয়, তখন সে আল্লাহর দোহাই দি‌য়ে আর্ত‌চিৎকার ক‌রতে খা‌কে, যেন বের করা না হয়। হাদী‌সে এসন‌টি এ‌সে‌ছে।
বস্তুত যারা লোক‌দের‌কে জে‌নেশ‌ু‌নে মস‌জিদবিমুখ করছেন, এবং মসজিদ আবা‌দে বাধা প্রদান কর‌ছেন, তা‌দের সাবধান হ‌য়ে যাওয়ার জন্য এ এক‌টি আয়াতই য‌থেষ্ট ম‌নে ক‌রি :
وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ مَّنَعَ مَسٰجِدَ اللّٰہِ اَنۡ یُّذۡکَرَ فِیۡہَا اسۡمُہٗ وَ سَعٰی فِیۡ خَرَابِہَا ؕ اُولٰٓئِکَ مَا کَانَ لَہُمۡ اَنۡ یَّدۡخُلُوۡہَاۤ اِلَّا خَآئِفِیۡنَ ۬ؕ لَہُمۡ فِی الدُّنۡیَا خِزۡیٌ وَّ لَہُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ ﴿۱۱۴﴾
“আর তার চেয়ে অধিক যালিম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহ্‌র মসজিদগুলোতে তাঁর নাম স্মরণ করতে বাঁধা দেয় এবং এগুলো বিরাণ করার চেষ্টা করে? অথচ ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়ে তাদের জন্য সেগুলোতে প্রবেশ করা সঙ্গত ছিল না। দুনিয়াতে তাদের জন্য লাঞ্ছনা ও আখেরাতে রয়েছে মহাশাস্তি।” (সূরা বাকারা : ১১৪)
আয়াত‌টি য‌দিও কা‌ফির সম্প্রদা‌য়ের ব্যাপা‌রে না‌যিল হ‌য়ে‌ছে, তথা‌পি কো‌নো মুস‌লি‌মের আচরণ কা‌ফির‌দের আচর‌ণের সা‌থে বা‌হ্যিক সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া কম বিপজ্জনক কিসে?
আল্লাহ আমা‌দের সুম‌তি দান করুন!
Saifuddin Gazi
09/03/21

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *