শাইখ মুহাম্মাদ আলী সাবুনী। ১৯৩০ খৃস্টাব্দের কোনো এক শুভক্ষণে সিরিয়ার হালাব শহরে একটি ইলমী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শাইখ জামিল সাবুনী ছিলেন হালাবের শীর্ষস্থানীয় আলিম। পরিবারিকভাবে সকলেই তারা শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষিত। ভাইদের সকলে আলিম, ডক্টর, ডাক্তার, কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
শিক্ষাদীক্ষা :
পিতার হাতেই তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি। অল্প বয়সেই তিনি কুরআন মাজীদের হিফয সম্পন্ন করেন। পাশাপাশি দীনের মৌলিক ও বুনিয়াদী শিক্ষাও অর্জন করেন।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জনের পর তিনি ব্যবসায় নিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। কিন্তু এতে যেহেতু সুদের হিসাব-নিকাষ পড়তে হয়, সেহেতু একবছর পর তিনি বিষয় পরিবর্তন করে ‘শরইয়্যা’য় ভর্তি হন। এখানে তিনি তাফসীর, হাদীস, উসুল, সহ প্রায় সকল শরঈ বিষয় অধ্যয়ন সম্পন্ন করেন। সেসঙ্গে কলেজের নিয়ম অনুসারে বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভুগোল, ইংরেজিসহ জাগতিক বিষয়াবলীতে শিক্ষা অর্জন করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন।
তারপর এরপর সিরিয়ার ওয়াকফ মন্ত্রণালয় থেকে স্কলারশিপ নিয়ে মিসরের জামিয়া আযহারে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে তিনি শরীয়া ফ্যাকাল্টি থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৪ সালে ‘ইসলামী কাযা ও বিচার’ বিষয়ে তাখাসসুস সম্পন্ন করেন এবং এ বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন, যা ডক্টরেট না হলেও ডক্টরেট সমমানের।
অধ্যাপনা :
মিশর থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৫৫-১৯৬২ পর্যন্ত হালাব ও সিরিয়ার বিভিন্ন কলেজে সুনামের সাথে অধ্যাপনা করেন। সেখান থেকে তিনি সৌদী আরবে গমন করেন এবং মক্কা বাদশাহ আবদুল আজীজ ইউনিভার্সিটিতে প্রায় ৩০বছর খেদমত করেন। তাঁর পান্ডিত্য ও জ্ঞান-গবেষণায় মুগ্ধ হয়ে ‘জামিআ উম্মুল কুরা’কতৃপক্ষ তাঁকে ‘তুরাসে ইসলামী’র প্রাচীন পাণ্ডুলিপি তাহকীকের জন্য গবেষক নিযুক্ত করেন। ইমাম আবু জাফর নাহহাস (মৃত ৩৩৮ হিজরী ) রচিত ‘তাফসীরে মাআনিল কুরআন’-এর একমাত্র পাণ্ডুলিপিটি তিনি তাহকীক করে দেন। ৬খন্ডে সমাপ্ত তাঁর তাহকীকসমৃদ্ধ তাফসীরটি উম্মুল কুরা’র তত্তাবধানে প্রকাশিত হয়। এরপর কিছুকাল তিনি ‘রাবেতা আলমে ইসলামী’র ‘কুরআন সুন্নাহর জ্ঞানগত অলৌকিতা বোর্ডে’ (هيئة الإعجاز العلمي في القرآن والسنة) পরামর্শক হিসাবে কাজ করেন। সর্বশেষ তিনি নিজেকে লেখালেখি ও গবেষণা-রচনার জন্য সম্পূর্ণ অবসর করে নেন।
মক্কা মুকাররমায় থাকাকালে তিনি মসজিদে হারামেও দরস প্রদান করেন। কাবাঘরের পবিত্র আঙিনায় তিনি নিয়মিত ফতওয়া প্রদান ও দরসের কাজ করতেন। সাপ্তাহিক একটি তাফসীরের প্রোগ্রাম তিনি জেদ্দাতেও নিয়মিত করতেন।
অধ্যাপনার এ দীর্ঘসময়ে তাঁর কাছে বহু ছাত্র পড়ালেখা করে এবং তাঁর হাতে অসংখ্য গুণী আলিম গড়ে ওঠে।
স্বীকৃতি ও পুরস্কার
তাঁর জ্ঞান-গবেষণা, কৃতীত্ব ও অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৪২৮ হিজরীতে তিনি ‘আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যক্তিত্ব’ নির্বাচিত হন এবং ‘দুবাই আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতা’ অনুষ্ঠানে আমিরাতের সুলতান তাঁকে পুরস্কৃত করেন।
আকীদা, ফিকহ ও চিন্তাধারা :
তিনি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের একজন প্রসিদ্ধ আলিম ছিলেন। ফিকহান তিনি হানাফী এবং আকীদায় আশআরী ছিলেন। আরবের হানাফী মুলধারার আলেমদের সাথে তার ভাল সম্পর্ক ছিল। যেমন শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ রহ.,শাইখ মুহাম্মাদ আওয়ামা প্রমুখ।
তিনি হক কথা বলতে দ্বিধা করতেন না, যদিও তা সরকারের বিপরীতে যায়। সিরিয়া যুদ্ধে খুবই আন্তরিকতার সাথে আহলে হকের সমর্থন করেছিলেন। হালাব লড়াইয়ের সময় জালেম শাহীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ের জন্য মু জা হি দী নের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছিলেন। সম্ভবত তখন তিনি মক্কা মোকাররমা অবস্থান করছিলেন।
রচনা ও গবেষণা :
শিক্ষকতা ও তৎপরবর্তী জীবনে তিনি বহু গবেষণাকর্ম উম্মাহকে উপহার দিয়েছেন। শরঈ ও আরবী বিষয়ে তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। যার অনেকগুলো বিশ্বের বহুভাষায় অনূদিত হয়েছে। এটি সুধীমহলে তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ বহন করে।
তাঁর যে অমর গ্রন্থটি বিশ্বের শিক্ষিত মহলে তাঁকে পরিচিত ও বিখ্যাত করে তুলেছে, তা হলো صفوة التفاسير ‘সফওয়াতুত তাফাসীর’। সহজ সংক্ষেপ ও সুন্দর উপস্থাপনার জন্য এটি ছাত্র, শিক্ষক ও কুরআনের জ্ঞান-পিপাসুদের টেবিলে টেবিলে। তাঁর ছোট বড় প্রায় পঞ্চাশটি গ্রন্থ রয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনোটি একাধিক খন্ডের, হাজার পৃষ্ঠার। তা ছাড়া মক্কা মুকাররমা ও জেদ্দায় প্রদত্ত তাঁর ফতওয়া, দরস ও তাফসীরী মসলিসগুলোর রেকর্ডগুলো সংরক্ষিত রয়েছে।
তাঁর রচিত ও তাহকীককৃত গ্রন্থের তালিকা অনেক দীর্ঘ। এখানে কয়েকটি কিতাবের নাম উল্লেখ করা হলো।
1-صفوة التفاسير.
2-المواريث في الشريعة الإسلامية.
3-من كنوز السّنّة.
4-روائع البيان في تفسير آيات الأحكام.
5-قبس من نور القرآن الكريم.
6-السنة النبوية قسم من الوحي الإلهي المنزّل.
7-موسوعة الفقه الشرعي الميسر (سلسلة التفقه في الدين).
8-الزواج الإسلامي المبكر سعادة وحصانة.
9-التفسير الواضح الميسر.
10-الهدي النبوي الصحيح في صلاة التراويح.
11-إيجاز البيان في سور القرآن.
12-موقف الشريعة الغرّاء من نكاح المتعة.
13-حركة الأرض ودورانها حقيقة علمية أثبتها القرآن.
14-التبيان في علوم القرآن.
15-عقيدة أهل السنة في ميزان الشرع.
16-النبوة والأنبياء.
17-رسالة الصلاة.
18-المهدي وأشراط الساعة.
19-المقتطف من عيون الشعر.
20-كشف الافتراءات في رسالة التنبيهات حول صفوة التفاسير.
21-درة التفاسير (على هامش المصحف).
22-جريمة الربا أخطر الجرائم الدينية والاجتماعية.
23-التبصير بما في رسائل بكر أبو زيد من التزوير.
24-شرح رياض الصالحين.
25-شبهات وأباطيل حول تعدد زوجات الرسول.
26-رسالة في حكم التصوير.
27-معاني القرآن (للنحاس).
28-المقتطف من عيون التفاسير (للمنصوري).
29-مختصر تفسير ابن كثير.
30-مختصر تفسير الطبري.
31-تنوير الأذهان من تفسير روح البيان (للبروسوي).
32-المنتقى المختار من كتاب الأذكار (للنووي).
33-فتح الرحمن بكشف ما يلتبس في القرآن (للأنصاري).
একজন কুরআনপ্রেমিক :
সবকিছু ছাড়িয়ে তিনি ছিলেন একজন কুরআন প্রেমিক। কুরআন বিষয়ে অসংখ্য বয়ান, বক্তৃতা, দরস ও হালাকা ছাড়াও শুধু কুরআন বিষয়েই সতেরটি গ্রন্থ রচনা করেন। গত রমাযানে ও রমাযান উত্তর সময়ে করোনাকালে তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। হাসপাতালের বেডে থেকেও প্রায় প্রতিদিন তিনি স্বীয় ছাত্রদের দিয়ে কুরআন মাজীদ শুনতেন। আগন্তুকদেরকে কুরআনের দরস দিতেন; যা বিশ্ববাসীকে বিষ্মিত করেছে।
আজ ১৯ মার্চ, ২০২১ ঈসায়ী, জুমাবার, ৫শা’বান ১৪৪২ হিজরী এ মহান ব্যক্তিত্ব মাওলায়ে পাকের ডাকে সাড়া দিয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ইহধাম ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজেঊন।
নবীজি সা.এর সুসংবাদ অনুযায়ী তিনি জুমাবারে ইন্তিকাল হওয়ার কারণে কবরের ফিতনা থেকে ইনশাআল্লাহ মুক্ত থাকবেন। আমরা দুআ করি, অবশিষ্ট ঘাটিগুলোও আল্লাহ তাআলা আপন মেহেরবানীতে তাঁকে পার করে দেন। তার সকল ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেন এবং সকল খেদমত কবুল করে নেন। তাঁর সকল ইলমী খেদমত ও রচনাসম্ভারকে উম্মতের জন্য জারি ও সারি রাখুন, আমীন!
-মুহাম্মাদ সাইফুদ্দীন গাযী
দারুল হিকমাহ
চৌমুহনী, নোয়াখালী
১৯ মার্চ, বা’দ জুমআ।
তথ্যসূত্র : সফওয়াতুত তাফাসীর এর ভূমিকা ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতায় : Yusuf al ubaidy