ইভ টিজিং : বুদ্ধিজীবিদের বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্ব

ইভ টিজিং নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বেশ কিছুদিন ধরে অনেক লেখালেখি হচ্ছে।ইভ টিজিং এর সমাধানের ব্যাপারে আমাদের বুদ্ধিজীবিরা অনেক কিছুই বলছেন। একজন মুসলিম হিসেবে আমার উপর দায়িত্ব আছে এই সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করা এবং সমাধানের চেষ্টা করা।

“তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যানের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।” [সূরা ইমরান-১১০]

এখানে অনেকগুলো ব্যাপার কাজ করে। এক-জীবন সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, দুই- আমরা সমস্যার সঠিক কারণ চিহ্নিত করতে পারছি কিনা, তিন-যে সমাধান প্রস্তাব করছি তার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করছি কিনা এবং তা প্রশান্তি (tranquility) দিতে পারছে কিনা ইত্যাদি।

মানুষের কিছু প্রবৃত্তি আছে, যা সৃস্টির আদিকালেও ছিল এবং ২০১০ সালেও আছে। সেক্সুয়াল ইন্সটিংট সেরকম কিছু। এই প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ করা না হলে সেটি বিভিন্ন সমস্যার জন্ম দেবে। ইভ টিজিং  এর সাথে এটাও একটা সম্পর্ক আছে, একটা ছেলে একটা মেয়েকেই সাধারণত tease করে, ছেলেদেরকে করেনা।

ভাসাভাসা ভাবে দেখলে সবাই একমত হন ইভ টিজিং এর পিছনে কারণ নারীর প্রতি দৃস্টিভঙ্গি, কথাটা সত্য। কিন্তু আদর্শিক দুর্বলতার কারনে পশ্চিমা জীবনদর্শন এটির কোন সমাধান দিতে পারেনি। আমাদের পরজীবি “বুদ্ধিজীবিরা” নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে,কেমন হবে,কিভাবে হবে এ ব্যাপারে পরিষ্কার এবং বাস্তব কোন দিকনির্দেশনা দিতে বরাবরের মত ব্যর্থ।

নারী-পুরুষের সম্পর্ক এবং নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বহুলাংশে নির্ভর করে সমাজে কিভাবে নারীদের উপস্থাপন করা হয়। আমরা এই সমাজে মেয়েদেরকে এমনভাবে উপস্থাপন করে এবং সমাজে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে যেখানে ইভ টিজিং ও অন্যান্য নারী ঘটিত অপরাধ একটি অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে দাড়িয়েছে।

বিজ্ঞাপনগুলোর দিকে দেখা যাক। কোমল পানীয় থেকে শুরু করে BMW গাড়ির বিজ্ঞাপন, সাবানের প্যাকেট থেকে শুরু করে মুদির দোকানের চাল- প্রায় সব বিজ্ঞাপনেই নারীদেহের সীমাহীন ব্যবহার। কোথাও বেশি কোথাও কম। প্রয়োজন হলেও আছে না হলেও আছে।  সহজ ভাষায় এই বিজ্ঞাপন গুলো পুরোপুরিই নারী সর্বস্ব, বারবার দৈহিক সৌন্দর্যের ব্যাপারটাই প্রাধান্য পায় এখানে।

এরপর আসা যাক beauty contest গুলোর দিকে। কে কত স্লিম, কোন মেয়ে কত লম্বা, কে কত যৌনাবেদনময়ী, কে কত রুপবতী – এই সুক্ষ হিসাবগুলোই আমাদের করতে শেখানো হয়। এদেশের অনেক মেয়েই বিকিনি পরে পোজ দেয়া না শিখলেও বিভিন্ন ভঙ্গিমায় আবেদনময়ী হিসেবে নিজেকে এক্সপোজ করতে জেনে গেছে– বিচারক-দর্শক উভয়ের মাথায় তা নিয়ে তর্ক- “কে বেশি আবেদনময়ী ?”। ঘুরে ফিরে চলেই আসছে নারীর শরীর।

নাটক-সিনেমা গুলোর মধ্যে একটা বিশাল অংশের থিম হল নায়ক-নায়িকার বিভিন্ন মাত্রার মিলন। অস্বীকার করার কিছু নেই, এই সম্পর্কের একটা বিশাল অংশ জুড়ে শারীরিক আকর্ষনের ব্যাপারটি জড়িত আর এগুলো এখন সরাসরি প্রকাশ করতে বর্তমানকালের প্রযোজকরা সিদ্ধহস্ত, তারা মোটেই লজ্জাবোধ করেন না। আর এইসব নাটক-সিনেমায়-বইপত্রে নারী-পুরুষের যে কোন সম্পর্ককেই উতসাহিত করা হয় হোক সেটা pre-marital বা extra-marital ।  সবচেয়ে ভাল উদাহারণ হল ফারূকীর “থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার”, “ফার্স্ট ডেট”, আনিসুল হকের “দ্বিতীয় জীবন”; হুমায়ুন আযাদ আর তসলিমা নাসরিনরা তো আছেই।

আর পর্নগ্রাফি তো একটা ভয়াবহ ভুমিকা পালন করেই।একটা পর্ন মুভিতে একটা মেয়েকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় তাতে আশা করা যায় না মেয়েদের প্রতি ছেলেদের ভাল কোন দৃস্টিভঙ্গি গড়ে উঠবে। সারারাত ধরে পর্ন দেখা একটি ছেলে যখন পরেরদিন সকালবেলা একটি মেয়েকে দেখলে তার impression হবে, তাতে নিশ্চিতভাবেই আগের রাতে দেখা মুভির ভাল প্রভাব থাকবে।

এইসব ব্যাপারগুলো সমাজের মানুষের মনে যৌন আলোড়ন (sexual agitation) সৃষ্টি করে। মানুষের ধারণাগুলো আসে তার পারিপার্শ্বিকতা থেকে। তার চিন্তার গতিপথ সেদিকে অভিমুখী হয় যেদিকে তাকে প্ররোচনা(provoke) দেয়া হয়। “Highest sensual pleasure”– যে সমাজের আদর্শের সাথে একীভুত সে সমাজে পুরুষরা নারীদের মুল্যায়ন করার ক্ষেত্রে শরীরের ব্যাপারটাই অনিবার্যভাবেই তাই প্রাধান্য পায় এবং মানবিক,সম্মান ও দায়িত্ব বিষয়ক ব্যাপারগুলোর গুরুত্ব কমে যায় আর ফলাফল আজকের সমাজ।

আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাপারটাই দেখা প্রয়োজন। এদেশে বিয়ে করতে নুন্যতম বয়স ছেলেদের ২১ হলেও কার্যত এটা সম্ভব হয় না বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে। কিন্তু সেক্সুয়াল ইন্সটিংট কাজ করতে শুরু করে ১৩-১৪ বছর বয়সে, সময়টা নিঃসন্দেহে দীর্ঘ। একদিকে বিয়ের পথ বন্ধ তেমনি অন্যদিকে খোলা রয়েছে ব্যাভিচারের পথ, মেয়েদের ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম নয়। এমনই এক সমাজ যেখানে ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ের সুযোগ নেই, তবে ১৪ বছরের মেয়েদের পতিতা হবার সুযোগ আছে। দুটি বিয়ে করা মোটামুটি সামাজিক অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, তবে ব্যাভিচার করলে দোষ নেই। অবাধ যৌনাচারের এই পথটি সমাজই খুলে দিচ্ছে,প্লেবয়  হতে চাওয়াটাও তাই স্বাভাবিক।

আমাদের জীবনদর্শন আমাদের কাজকর্ম ও আচার-আচরণের রুপ দেয়, আর নিঃসন্দেহে আমাদের এই ধারণাগুলো পশ্চিমাদের জীবনদর্শনের একটি বিশেষ শাখা থেকে এসেছে,যার নাম LIBERALISM। নারী-পুরুষের সম্পর্ককে তারা এক্সক্লুসিভলি একটা সেক্সুয়াল সম্পর্কের লেন্স থেকে দেখে, যা স্পষ্টত বোঝা যায় তাদের সমাজের দিকে দেখলে, সমাজে যৌনউদ্দীপক বিষয়গুলোর ব্যাপক ছড়াছড়ি, আমাদের সমাজও একই পথে যাচ্ছে। সমাজে এই ধরণের উদ্দীপক বিষয় গুলো মানুষের মনে অস্থিরতা সৃষ্টি করে, সাময়িক শারীরিক আনন্দ দিতে পারলেও প্রশান্তি আসে না।

তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা ইভটিজিং এর বিরুদ্ধে কথা বলেন ঠিক, কিন্তু তারা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বের কারণে এটা বুঝতে পারেন না সমাজের কোন সব বিষয়গুলো এর জন্য দায়ী। “দৃষ্টিভঙ্গি বদলাও জীবন বদলে যাবে” এটা ততক্ষন পর্যন্ত অসম্ভব যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজে sexuality stimulating element গুলো উপস্থিত থাকবে। “সচেতনতা বাড়াতে হবে” বললে সচেতনতা বাড়ে না, উপযুক্ত পরিবেশ থাকতে হবে।

পশ্চিমাদের জীবনদর্শনে এই প্রবৃত্তিটিকে দেখা হয় শুধুই সেক্সুয়ালিটির ভিত্তিতে, কিন্তু ইসলামে এই প্রবৃত্তিটিকে দেখা হয় বংশবিস্তারের মাধ্যম হিসেবে, এবং ব্যাপারটির সমাধান দেয়া হয়েছে বিয়ের মাধ্যমে,যা একই সাথে প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি মানসিক প্রশান্তির কাজটি করবে। যেহেতু এই বিষয়টিকে ইসলাম বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে নির্দিষ্ট করে, তাই ইসলাম পাবলিক লাইফে এই যৌনউদ্দীপক বিষয়গুলোর অনুপস্থিতিকেও নিশ্চিত করে।

অবাধ যৌনতা কিংবা সন্যাসব্রত –ইসলাম দুটো extreme কে বাদ দিয়ে সমাধানের অংশ হিসেবে দিয়েছে বিয়ে, যা এক্সক্লুসিভলি শুধুমাত্র দৈহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে উঠে না, বরং, এই সম্পর্কের ভিত্তিতে আছে পারস্পরিক দায়িত্ববোধ ও সততার মত বিষয়গুলো ।

“আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।” [সূরা রুম-২১]

ইসলাম নিষিদ্ধ করে সমাজে সেইসব জিনিষের উপস্থিতি যা মানুষের মনে নিরবিচ্ছিন্ন উত্তেজনা সৃষ্টি করে আর ফিতনা সৃষ্টি করে। এটা করা হয় হিজাবের মাধ্যমে এবং নারী-পুরুষের অপ্রয়োজনীয় সম্পর্কের ইতিটি টেনে। আল্লাহ সুবহানাল্লাহ ওয়া তা’আলা বলেছেন,

“মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।” [সূরা নূর-৩০]

“ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে …” [সূরা নূর-৩১]

“নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ, মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ, ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ, অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ, সত্যবাদী নারী, ধৈর্য্যশীল পুরুষ, ধৈর্য্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ, বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ, দানশীল নারী, রোযা পালণকারী পুরুষ, রোযা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ, , যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী নারী, আল্লাহর অধিক যিকরকারী পুরুষ ও যিকরকারী নারী-তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরষ্কার।” [সূরা আহযাব-৩৫]

এই পরিবেশ নিশ্চিত করে ইসলাম বৈবাহিক সম্পর্কের বাহিরের সম্পর্কের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান দিয়েছে এই জীবনে এবং আখিরাতেও, একই সাথে বিধান দিয়েছে কঠোর শাস্তি তাদের জন্য যারা মিথ্যা অপবাদ দেয়।

“ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে একশ’ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর কারণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।”  [সূরা নূর-২]

“যারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে অতঃপর স্বপক্ষে চার জন পুরুষ সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত করবে এবং কখনও তাদের সাক্ষ্য কবুল করবে না। এরাই না’ফারমান।” [সূরা নূর-৪]

“যারা পছন্দ করে যে, ঈমানদারদের মধ্যে ব্যভিচার প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্যে ইহাকাল ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।” [সূরা নূর-১৯]

ইসলাম মানুষকে একটি সঠিক জীবনব্যবস্থা দেয় যার মাধ্যমে সে নিজে ভাল থাকতে পারে এবং আল্লাহ আয ওয়া যালের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে। তাই কোন মুসলিমাহর আইডল দেহসর্বস্ব ঐশ্বরিয়া নয়, কিংবা কোন মুসলিমও প্লেবয় হতে চাইবেনা।

“হে ঈমাণদারগণ! বলপূর্বক নারীদেরকে উত্তরাধিকারে গ্রহন করা তোমাদের জন্যে হালাল নয় এবং তাদেরকে আটক রেখো না যাতে তোমরা তাদেরকে যা প্রদান করেছ তার কিয়দংশ নিয়ে নাও; কিন্তু তারা যদি কোন প্রকাশ্য অশ্লীলতা করে! নারীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন কর। অতঃপর যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে হয়ত তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ, অনেক কল্যাণ রেখেছেন।” [সূরা নিসা-১৯]

ইসলামের সমাধানগুলো সম্পুর্ন রুপে আসতে পারে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রের মাধ্যমে, যা ইসলামের হুকুম আহকাম গুলোকে বাস্তবায়িত করবে। আল্লাহ আমাদেরকে সে তৌফিক দিন এবং আমাদেরকে সৎ মুসলিম হিসেবে মৃত্যুদানের সুযোগ করে দিন।

যাযাকাল্লাহু খায়ের।



Collected From:

Brother

Zim Tanvir

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *