শহরের শেষ বাড়ি ও কিছু মৃত্যু

এক অর্থে সেটাই ছিলো শহরের শেষ বাড়ি। সরু গলির মাথার যেখানে শেষ , একমুখী রাস্তার প্রান্তবিন্দু হয়ে ছিল  বাড়িটি। শহরের কোলাহল ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে আসতে আসতে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেত। যখন নীরবতার স্তব্ধ রূপ প্রকট হয়ে উঠত তখন আমি নিজেকে আবিষ্কার করতাম শৈশবের দেখা বিটিভির সেই আলিফ লায়লার সিনবাদের ভূমিকায়, যে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা জুতা পায়ে ঠক ঠক করে শয়তানের প্রাসাদে ঘুরে বেড়াতো। শুধু ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’। অন্য কোন শব্দ নেই।

চারতলায় থাকতাম আমরা। বাড়িটির তিন দিকে কবরস্থান আর এক দিকে সরু গলি দিয়ে প্রবেশপথ। একটি বিশেষ কারণে বছর দেড়েক আমাদের অবস্থান করতে হয়েছিল সেই লাইট হাউসের মতন বাড়িটিতে।

দিনের বেলায় কোন পার্থক্য বোঝার উপায় ছিল না। তবে ঢাকা শহরের অবিরাম যান্ত্রিক কোলাহল থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। দিনের বেলাতেও বাতাসে নারিকেলের পাতায় সরসর আওয়াজ টের পাওয়া যেত একটু কান পাতলে। মাঝে মাঝে শেষ রাতের ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের হুইসেলের শব্দ ছাড়া তেমন কোন  কোলাহল ছিল না।

নীরবতার অনেক রূপ আছে। তার একটি রূপ সোনালী। যখন প্রকৃতির কাছাকাছি চলে যাওয়া যায় তখন তা রূপবতী হয়ে উঠে। প্রকৃতির কোনো ভাষা নেই, ‘যদি দেখতে পারো তবে বুঝে নিও’। গ্র্যাণ্ড ক্যানিওনের বিশাল গিরিখাতে নিস্তব্ধতা ভেদ করে যাওয়া চিলের চিৎকার অনেক সুমধুর। তাই আমি কান পেতে রই। এরকম তীব্র নিশ্চুপ রূপের অনেক কাছাকাছি যাবার সুযোগ হয়েছিল আরেকবার। শাহজীবাজার চা বাগানে যাবার পথে। একা একা বের হয়েছিলাম ক্যামেরা হাতে। দুধারে গহীন রাবার বাগান। পাহাড়ি বন । তার মাঝখানে কিছুদূর চলার মতন ইটের পথ। পথের শেষে মাটির রাস্তা। আর কিছুদূর এগুলে এরপর চা বাগান। রোদ ঝলমলে দিনটিতেও অনেক আলো আঁধারি খেলা করে গিয়েছিল পথে বনে।  মাঝ দুপুরেও উত্তপ্ত মরু প্রান্তরে আরব বেদুঈনরা ইসলাম পূর্ব জীবনে উপাসনা করত নানান কাল্পনিক দেবতা আর জ্বিনের, এই অসহ্য নিস্তব্ধতা থেকে মুক্তি পেতে। শিস কেটে চলে যাওয়া বাতাসে নিজের সাথে কথা বলা ছাড়া কিছু করার থাকে না এমন সময়।

সে অর্থে যান্ত্রিক নাগরিক জীবনের নীরবতার সোনালী আলো পুরোপুরি সোনালী নয়, ইমিটেশনের গয়নার মতন সোনালী বলা যেতে পারে। খুব বিরক্তিকর , আর একটা মৃত্যুপুরির ভাব নিয়ে চারদিক থেকে সংকুচিত হয়ে আসে ইট কাঠের দেয়ালগুলো। নিজেকে মনে হয় পৃথিবী আক্রমণকারী এলিয়েনদের অবহেলার শিকার হয়ে বেঁচে থাকা শেষ মানব। হৃদপিণ্ডের ধুকপুকের সাথে ছন্দ মিলিয়ে যায় মাঝরাতের ঘড়ির কাঁটা।

বাসার দুদিকে দুটো বারান্দা ছিল। সম্ভবত উত্তর দিকেই হবে, যেদিকের বারান্দার দরোজার প্রবেশপথ  বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল আমার বিরোধিতা সত্ত্বেও। বিশেষ পরিস্থিতিতে কিছুদিনের জন্য ঐ বাড়িতে অবস্থান করেছিলাম। অনেক ছোট পরিসরের হওয়ার কারণে আসবাবপত্র রাখার চাপাচাপিটা ছিল ফ্রি কিক ঠেকানো ওয়ালের মত। উত্তরের বারান্দার ভিঊ না দেখার জন্যে ঐ দরোজা বন্ধ করে দেয়া হল। যদিও ছোট ছিল তবু অন্তত বারান্দায় যাবার দরোজাটা খোলা রাখা যেত। কিন্তু আলমারি টেনে এনে বন্ধ করে দেয়া হল ঐ দরোজা। কারণ বুঝতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হল।

যে কোন বারান্দার একটা একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তার ভিউ। সেদিক থেকে ঐ বারান্দায় যাবার তেমন কোনো কারণ নেই। কারণ এক অর্থে শহরের শেষ ঐ বাড়িটির, তিন দিকে একেবারে দেয়াল ঘেঁষেই ছিল কবরস্থান। আর উত্তরের বারান্দার নিচের কবরগুলোর ছিলো অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের। কতগুলো তিন আড়াই ফুট দুয়েকটা চার ফুট। মানে, ওগুলো বাচ্চাদের কবর।

আমি আমার নিজের বাসায় ক্যাডেট কলেজ থেকে ছুটিতে অতিথি হিসেবে আসি। বাসার পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে এক দুদিন সময় লাগে প্রতিবার। প্রথম যখন আসি তখন এইরকম শীতকাল। ডিসেম্বরের শীত। সকাল বিকাল কুঁয়াশা। প্রথম রাতে বেশ ভালোই ঘুম দিলাম লেপ মুড়ি দিয়ে। বাসার অদ্ভুত ভুতুড়ে পরিস্থিতি নিয়ে মাথা ঘামানোর ফুসরৎ নেই।

প্রথম বিষয়টা টের পেলাম দ্বিতীয় রাতে।

আমাদের বাসার সবাই ছোটবেলার সেই আর্লি টু বেড,আর্লি টু রাইজ নীতিতে বিশ্বাসী। নয়টার মাঝেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। আমিও কোনো কাজ না থাকায় দশটার পরে খুব কম রাতেই জেগে থাকতাম। লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। এর মাঝে হঠাৎ ধুপ ধাপ শব্দ। কিছুক্ষণ থেমে থেমে। একটু পর পর। এর মাঝে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ। অতি প্রাকৃতিক কোনো বিষয়ে বিশ্বাস করার কারণ নেই। তবে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিষয়টা আমল না দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।

পরদিন সকালেই সব পরিষ্কার হল। একটি নতুন বাচ্চার কবর দেয়া হয়েছিল গত রাতে।

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম উত্তরের বারান্দার দরোজা খুলতে হবে। যতোই আম্মু অজুহাত দিক না কেন, আসুক হিমালয়ের শীতল হাওয়া হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে। আসলে সেসব কোনো কারণ ছিল না।

সাধারণভাবে মানুষ মৃত্যুকে ভুলে থাকতে চায়। চোখের সামনে যেখানে প্রতি সপ্তাহে একটি দুটি নতুন কবর পরে; ঐ বারান্দায় দাঁড়িয়ে তা খুব কম মানুষই দেখতে চায়। বিশেষত যদি কারো বয়স বেড়ে যায়।

বারান্দা খোলা হল। আগেই বলেছি শহরের শেষ বাড়ি হওয়ায় আশপাশ বেশ খোলামেলা। বারান্দায় বসে সন্ধ্যার লাল দিগন্ত দেখা যায়। তবে ওখানে বসে দেখা সেরা দৃশ্যটি নিচের দেয়ালঘেরা কবরস্থানের সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত। কোনো এক কারণে বিষণ্ণ হয়ে বারান্দায় বসে আছি। রাতের বেলা। লোডশেডিং। শীতকাল। দূরে শহরের যে প্রান্তে  আলো জ্বলছে সেদিকে তাকিয়ে আছি, আর এখানে অন্ধকার। আকাশ ভরা রাতের তারা। এর মাঝে এক টুকরো সাদা মেঘ বেরসিক ভাবে ঘোরাফেরা করছিল। শীতের রাতের আকাশে পুরো বেমানান। এত সুন্দর ভ্যান গগের স্টারি নাইটে  কেন এরকম বেরসিক সাদা মেঘ আসলো, এরকম ভাবছি আর উপরে তাকিয়ে আকাশ দেখছি। হঠাৎ দেখি আকাশে ভি সৃষ্টি করে উড়ে যাচ্ছে এক ঝাঁক অতিথি পাখির দল। রাতের আকাশে পাখি দেখা মানে বাদুড় নামক চামচিকার উড়াউড়িকেই জেনে এসেছি এতদিন। সেখানে আমার চোখে ধরা পড়ল কিনা অতিথি পাখির ঝাঁক ! বেরসিক সাদা মেঘখণ্ডের বিব্রতবোধ আর ইতস্তত ঘোরাফেরার কারণ এবার স্পষ্ট হল। আহ কি চমৎকার দৃশ্য ! সন্ধ্যার আকাশে ঘরে ফেরা পাখিদের ঝাঁক দেখেছি অনেক, লাল কমলা দিগন্তে কালো ছায়ামূর্তি হয়ে ঊড়ে চলে, কিন্তু এমন অন্ধকার লোডশেডিং রাতের আকাশে ভেসে চলা সাদা পাখির ঝাঁক দেখিনি তো কখনো। লম্বা গলার পাখিদের উড়ে চলা  দেখতে লাগলাম যতটুকু দৃষ্টিসীমায় পড়ল। আমার প্রিয় সময়গুলোর একটি হয়ে থাকল দৃশ্যটি। সুযোগ পেলেই বারান্দায় বসে বসে সময় কাটাতাম।

কিন্তু , বিপরীত দৃশ্যগুলোই বেশি মনে পড়ছে আজ। প্রায় সপ্তাহেই দেখতাম একটা না হলেও দুটা নতুন কবর খোঁড়া হচ্ছে। একদিন প্রবল বৃষ্টির রাত। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। কবরস্থানে বাতির তেমন ভালো ব্যবস্থা নেই। একটা খুঁটিতে চোরাই বৈদ্যুতিক লাইনে লাগানো হলুদ ষাট ওয়াটের মতো একটা বাতি জ্বলছে আর বারবার সেই বাতি বৃষ্টির রাতের প্রবল বাতাসে নারিকেল পাতার ফাকে ফাকে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। একটু সময়ের জন্যে বৃষ্টি থামলে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। একটি নতুন কবর খোঁড়া হয়েছে। পানিতে থই থই। এর মাঝেই একটা খাটিয়া চলে আসলো। তাদের পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব  ছিলো না। হয়তো সকালে বা দুপুরে মারা গেছে। আরো একটি রাত অপেক্ষা করা মানে অনেক সময়। সারাদিনের প্রবল বর্ষণে কাদা মাখা মাটি পেরিয়ে তাকে বহন করে আনা হলো। আমি ওখানে বসে বসে পুরো দাফন প্রক্রিয়াটা দেখলাম। মাথায় করে নিয়ে আসা, কবরে নামানো, বৃষ্টি, কাদা, পানি কোনো কিছুই আর মাত্র একটা রাতও কাটাতে দিল না তাকে। কেউ অপেক্ষা করতে চায়নি সকাল হওয়া পর্যন্ত। হয়তো ইতোমধ্যে অনেক সময় অপেক্ষা করা হয়ে গেছে। দুজন লোক কবরে নেমে কোলে করে সাদা কাপড়ে জড়ানো দেহটিকে নামিয়ে দিল। এই বৃষ্টিতে কবরের ভিতরে কি হাল হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। ছোট্ট দেহটি কি একটুও বলছিল না আমাকে কোথায় রেখে গেলে ? পাথরের মতন মুখ করে থাকা মানুষগুলো কিভাবে মাটি চাপা দিয়ে চলে গেল। অন্ধকারে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে দুলতে দুলতে মিলিয়ে গেল ছায়ামুর্তিগণ। বাচ্চাদের কবরে আরেকজন প্রতিবেশি যুক্ত হল।

আরো অনেকের কবর দেয়াই দেখা হয়েছে অনেক সময় ঐ বারান্দায় বসে বসে। কিন্তু অন্ধকার রাতের তারাময় আকাশের হঠাৎ দেখা অতিথি পাখিদের মতন আজো বারবার ভেসে উঠে ঐ ছোট্ট সাদা কাপড়ে জড়ানো দেহখানা । মাটি চাপা দিয়ে রেখে যাবার দৃশ্যটি, সেই বৃষ্টির রাতে।

বড় অদ্ভূত আর নিষ্ঠুর এ পৃথিবী। 

দৃশ্যগুলো অনেক বেশি ভাবিয়ে তুলত আমাকে। কেন আসলাম পৃথিবীতে, কেন কোথায় চলে যাচ্ছে সবাই। শুধুই কি ক্ষণিকের অর্থহীন অবস্থান ?

 ____________________________________

[ যারা আল্লাহ তায়ালাকে অস্বীকার করেছে তারা কি দেখে না, আসমানসমূহ ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিলো, অতঃপর আমিই এদের উভয়কে আলাদা করে দিয়েছি এবং আমি প্রাণবান সবকিছুকেই পানি থেকে সৃষ্টি করেছি, এরপরও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না?

আমি যমীনের উপর সুদৃঢ় পাহাড়সমূহ রেখে দিয়েছি যেন তা ওদের নিয়ে নড়াচড়া করতে না পারে, এ ছাড়াও ওতে আমি প্রশস্ত রাস্তা তৈরী করে দিয়েছি যাতে করে তারা পৌঁছুতে পারে।

আমি আকাশকে একটি সুরক্ষিত ছাদ হিসেবে তৈরি করেছি, কিন্তু এ ব্যক্তিরা তার  এ নিদর্শনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ।

আল্লাহ তায়ালাই রাত,দিন,সূর্য ও চন্দ্রকে সৃষ্টি করেছেন; প্রত্যেকেই কক্ষপথে সাঁতার কেটে যাচ্ছে

(হে নবী) আমি তোমার পূর্বেও কোনো মানব সন্তানকে অনন্ত জীবন দান করিনি; সুতরাং আজ তুমি মরে গেলে তারা কি এখানে চিরজীবী হয়ে থাকবে ?

প্রতিটি জীবকেই মরণের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে, আমি তোমাদের মন্দ ও ভালো অবস্থার মধ্যে ফেলেই পরীক্ষা করি এবং আমারই কাছে তোমরা ফিরে আসবে ]  [ ২১:৩০-৩৫]

[“বলুন , যে মৃত্যুর কাছ থেকে তোমরা আজ পালিয়ে বেড়াচ্ছো, একদিন কিন্তু তোমাদের সে মৃত্যুর সামনাসামনি হতেই হবে, তারপর তোমাদের সে মহান আল্লাহর দরবারে হাজির করা হবে,যিনি মানুষের দেখা অদেখা যাবতীয় সম্পর্কেই জ্ঞান রাখেন, অতঃপর তিনি সেদিন তোমাদের সবাইকে বলে দেবেন তোমরা দুনিয়ার জীবনে কি করে এসেছো”] [৬২:৮]

আসমান যমীন ও তাদের মধ্যবর্তী যা আছে, তা আমি খেল তামাশার জন্য সৃষ্টি করিনি

আমি যদি নেহায়েত কোনো খেলতামাশার বিষয়ই বানাতে চাইতাম তাহলে আমি আমার কাছে যা আছে তা দিয়েই বানিয়ে দিতাম।

বরং আমি সত্যকে মিথ্যার উপর ছুঁড়ে মারি, অতঃপর সত্য মিথ্যার মগয চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয়, অতঃপর মিথ্যা সাথে সাথেই নিশ্চিহ্ণ হয়ে যায়। তোমরা যা বলছো, তার জন্য তোমাদের দুর্ভোগ।

[২১:১৬-১৮]

Collected From

Brother

Sifat E Mohammad

[“বলুন , যে মৃত্যুর কাছ থেকে তোমরা আজ পালিয়ে বেড়াচ্ছো, একদিন কিন্তু তোমাদের সে মৃত্যুর সামনাসামনি হতেই হবে, তারপর তোমাদের সে মহান আল্লাহর দরবারে হাজির করা হবে,যিনি মানুষের দেখা অদেখা যাবতীয় সম্পর্কেই জ্ঞান রাখেন, অতঃপর তিনি সেদিন তোমাদের সবাইকে বলে দেবেন তোমরা দুনিয়ার জীবনে কি করে এসেছো”] [৬২:৮]

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *