মসজিদ

জুম্মার আজানের পর ইমাম সাহেব মাইকে লম্বা একটা ঘোষনা দিলেন। এলাকার রহিম সবুজ আর মসলেহ সবাই কান খাড়া কইরা শুনলো। হাতের কাম ফালায়া সবুজ গামলার পানিতে হাত দুইটা ঘইসা ঘইসা ভেত্তা মাটিগুলি পরিষ্কার করতে করতে কইলো– কি হইলো কতো দেখি? হুজুর তো এমন কইরা কোনোদিন সবাইরে ডাকেনাই। কাহিনি কি? ধানের গোড়া পায়ের লগে একটা বাড়ি দিতেই মুখে কয়েক দলা কাঁদা লাগলো রহিমের। কয়ঃ কি জানি- মনে হয় জরুরী কোনো বিষয়।

সারা মসজিদ গিজ গিজ করতাছে। বারিন্দা ভইরা সামনে উঠানেও মানুষের ভিরে ভরা। এলাকার জোয়ান বুড়া লেটকি পেটকি সব আইয়া হাজির। মোয়াজ্জিন সাব হোগলাগুলি কান্ধে কইরা নিয়া বাইরে মাটির মইধ্যে বিছায়া দিলো। পোলাপাইনগুলা যেমন প্রতিযোগিতায় নামছে। কে কার আগে বইবো। একজন আরেকজনের কোলের মইধ্যে বয়া শুরু করছে। এইহানদিয়া এক পিচ্চি আরেক পিচ্চিরে কয়– ঐ ছালেম- তোর অজু অয়নাই। ঐযে পায়ের মুইরার মধ্যে লোদ লাইগ্যা রইছে। যা ধুইয়া আয়। মনে নাই হুজুরে কইছে পায় ময়লা থাকলে অজু অয়না। অজু মানে পরিস্কার করন। আল্লার সামনে খাড়াইবি। যা– ছালেম মনে মনে কষ্ট পায়। আহারে আবার পুকুরে যাইতো অইবো। কি ঝামেলা। এমন সময় হুজুরের দরাজ কন্ঠ শুইনা সবে চুপ হয়া গেছে।

আচ্ছালামু আলাইকুম। প্রিয় এলাকাবাসী। আমাগো এলাকার এই দূর্দিনে আমাগো সবাইর এক হইয়া থাকতে হইবো। মনে রাইখেন- বালা মুছিবত এইসবই আল্লার পরীক্ষা। আল্লায় আমাগোরে পরীক্ষা করনের লাইগা এইসব দেয়। এহন এই দূর্দিনে মন্দা খরায় আমরা সবাই যদি মিলা মিশা এইটারে সামাল দিতে পারি তাইলে আগামীর দিনগুলাও ভালো কইরা সামনের দিকে যাইতে পারুম। এলাকার যারা ধনীরা আছেন আপনেরা অন্তত এই সিজনটায় একটু ছাড় দিয়েন গরীবেগো লাইগা। আমাগোই তো সুখ দুঃখ। আমরা নিজেরা যদি ভাগাভাগি করি তাইলে আল্লায়ও আমাগো দুঃখ কমায়া দিবো আশা করি।

এমন সময় রহিম সাব উইঠা দাড়ায় কয়, হুজুর একটা কথা কইতাম।

হুজুর তার দাড়ি ওয়ালা মুখে একটা সুন্দর হাসি দিয়া কনঃ বলেন রহিম সাব।

রহিম সাব এলাকার সবচেয়ে ধনী মানুষ বলা যায়। তার পোলাপাইন সব ঢাকা পড়ালেহা করে। উনি নিজেও শিক্ষিত মানুষ। তাই সবাই উনার কথারে সম্মান করে। উনি বেশ কিছুক্ষণ একটা দম নিয়া কইলেনঃ হুজুর আমরা চাইছিলাম মসজিদটা একটু পাঁকা করতাম। আল্লার ঘরে মানুষজন ইবাদত বন্দেগী করবো। তাছারা পূবের গ্রামের সবাই মিলা ঐ গ্রামের মসজিদটা কতো সুন্দর কইরা সাজাইছে। দেখলেই পরানটা জুড়ায়া যায়। তাছাড়া আপনে আমাগো ইমাম সাব মানুষ। আপনের থাকার জন্য ভালো একটা ঘরের ব্যাবস্থা করন দরকার।

কথাটা কয়া তখনও শেষ হয়নাই। ইমাম সাহেবের চোখ থেকে একটা ফোঁটা গরম তরল গড়ায়া পড়লো। আমার গ্রামের মানুষ খাইতে পায়না। তারা একবেলা খায়া কোনোরকমে দিন কাটায়। আল্লায় এগো মতো এতো গরীব হয়া যায়নাই যে তারে সবাই মিলা সাহায্য করন লাগবো। আরে রহিম ভাই। ইমামের কন্ঠে ভাঙ্গা কান্দনের শব্দ শোনা যায়। মসজিদে আইজকা সবাইরে আইতে কইছি তাই সবাই আইছে। এছাড়া কয়জনে নামাজ পড়ে? পারলে নামাজি বাড়ানোর চেষ্টা করা দরকার। আইজকা যেমন সবাই আইছে এমন কইরা যদি দিনে পাঁচবার আমরা নিজেরা নিজেগো চেহারা দেখতাম তাইলে কি গ্রামে আর শত্রুতা থাকতো? সবাই তো সবাইর ভালো কামনা করতাম। আর আমি যেই ঘরে আছি বর্ষাকালে পানি পরলেও ঐখানেই আমার শান্তি। মাইনসের দান খয়রাতের টাকায় আমার এতো ভাব দেখানোর দরকার নাই। আমি চাইলেই আপনেগো কাছে বেতন নিতে পারতাম। কিন্তু আমারে যখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আপনাগো সাথেই পড়তে হইবো তাইলে খালি খালি নামাজ পড়ায়া বেতন নিমু ক্যান?? আমার ঐ মাদ্রাসার চাকরিটাই যথেষ্ট আমার ছোট্ট সংসার চালানোর জন্য। আর সকালে ঘুমের পড়ে তো আমার পোলারে পড়ানো লাগে হেই লগে আমারও কোরান তিলাওয়াত করতে হয়- তাই আমার ঘরের উঠানে আপনেগো পোলামাইয়াগোরেও ডাইকা লই যাতে আমার মতো মুর্খের মাথায় ইসলামের যা জ্ঞান আছে তা যেনো ঢাইলা দিতে পারি।

মুসল্লিদের মইধ্যে কিছু মানুষ পাশের গ্রামের মেহমান আছিলো। হেরা তো মন্ত্রমুগ্ধের মতো হুজুরের কথা শুনতাছে আর নিজেগো চোখের পানি ফালাইতাছে। আসলে যা কইছে এতে চোখের পানি ফালানোর কি হইলো? কিন্তু এর পরেও হুজুরের গলায় কি যেনো একটা মায়া আছে। আর হুজুর কতো বড় মনের মানুষ। বিনয়ের সথে নিজেরে মূর্খ কয়। আর তাগো মসজিদের ইমাম নিজেরেই সবাইর চেয়ে জ্ঞানী কয়। ধিরে ধিরে চোখের সামনে দুইজন সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষের ছবি চোখে ভাইসা ওঠে।

বহুদিন গড়াইয়া যায়। দিনে দিনে মুসল্লির সংখ্যা বাড়তে থাকে। হুজুরের আকর্ষনীয় কথা আর সহজ সরল জীবনের মধ্যে কি জানি অবাক একটা টান আছে। সবাই এইডা বেশ টেড় পায়। তাই তো এলাকার যেই পোলাপাইনগুলা মালেক স্যারের বাসার সামনে প্রাইভেট পড়তে আসা মাইয়াগুলিরে জালাইতো হেরাও ধিরে ধিরে মসজিদে যাওন শুরু করে। এলাকার বুড়ারা আফসোসে মনে অয় মইরাই যাইবো। কেন এমন ইমামরে যোয়ান কালে পাইলোনা। হেরা অবাক হইয়া দেখে ইমাম সাব বাসায় ফিরনের পথে কতো সোন্দর কইরা ঐ পোলাপাইনগোরে সাথে লইয়া দোকানে বইয়া আড্ডা দেয়। একবার সলিম মুন্সি তার ফোকলা দাঁতের মুখে কইলো ঐ বান্দর পোলাপাইনের লগে কি কথা কইতে যান?? ঐগুলা সব বদের হাড্ডী। হুজুরের জবাব শুইনা সলিম এমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকাইছিলো যে আর কোনো কথাই কইতে পারেনাই। হুজুর কইছিলোঃ সলিম চাচা। ওরা তো আমাগোই সন্তান। আমাগোইতো কাম ওগোরে কছে টাইনা বুঝানো দুনিয়া আখেরাত আর ভালো মন্দ।

বর্ষার সিজনে পুরা গ্রামে বন্যা বইয়া যায়। হুজুরের ঘুম নাই তার এলাকার মানুষের লাইগা। রাইত বিরাতে যেইসব বাড়ীতে পানি উইঠা গেছে ঐখানে গিয়া মানুষের পোলা মাইয়া গোরে কোলে কইরা গ্রামের একমাত্র উচা যায়গা মসজিদে আইনা রাখতেছে। হুজুরের লগে হুজুরের বউও আছে। বুড়ি বুড়ি মহিলাগোরে আপন মাইনসের মতো কান্ধে কইরা আইনা মসজিদে রাখতাছে। ভাঙ্গা মসজিদে রাইতে বৃষ্টি হইলে পানি পড়তে থাকে। কইত্থেকা হুজুরের চৈদ্দ বছরের পোলা টোকায়া টোকায় টিন আইনা ভাঙ্গা চালের মইধ্যে লাগানোর চেষ্টা করতে আছে। গ্রামের মানুষ অবাক চোখে চাইতে থাকে এই মানুষটারে। কি তার বউ!! কি তার পোলা!! গ্রামে ঢাকা থেকে মানুষ আইয়া রিলিফ দিয়া যায়। হুজুর সবাইরে ভাগ কইরা সবার শেষে নিজেরটা আর নিজের পোলা, বউরটা নেয়।

বিকাল হইয়া গেছে। সন্ধ্যা প্রায় হইবো হইবো ভাব। এমন সময় দূর থিকা একজন মানুষরে সবাই আইতে দেখে। কেডা ঐডা? সলিম মুন্সি গায়ের ভিজা গামছাটা দিয়া মুখ মুছতে মুছতে জোরে জোরে বিড় বিড় কইরা কয় আরে ঐটা মজিদ না? হ, পূবের গ্রামের মজিদ। মজিদ মাজা সমান পানি পার হইয়া ক্লান্ত পায় আইসা মসজিদের সিড়িতে ধপ কইরা বইয়া পড়ে। ইমাম সহেব তার দুই চোখে ক্ষুধার আগুন দেখতে পাইয়া নিজের হাতের খাবারের প্যাকেটটা তুলে ধরে। মজিদ ক্ষুধায় কোনো দিকে খেয়াল না কইরা হাপুস হুপুস খাইতে থাকে। মজিদ জানেনা। মসজিদ ভর্তি লোকজন সবাই কেবল জানে ঐ পেকেটটা ইমামের ভাগের একমাত্র প্যাকেট আছিলো। 

by brother Hasan Al Banna

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *