সম্ভাবনা

গতকাল রাতে খুব মন খারাপ করে নোট লিখছিলাম, নোটের নাম ‘অন্ত:সারশূন্যতা।’ অর্ধেক পড়ার পর বাকিটুকু লেখার আগ্রহ উবে গেল। তারপরেও কোনমতে টেনে টুনে শেষ করলাম। পাবলিশ করার আগ মূহুর্তে মনে হল, এটা আমার গল্প, আমিই পড়ে নেতিয়ে যাচ্ছি, অন্যদের কেমন লাগবে? এইটা এখন পাবলিশ না করি, আমার হয়ত এর চেয়ে ভাল কিছু লেখার সুযোগ আসবে। হতাশার বদলে ভাল কিছুও হয়ত দিতে পারার সুযোগ আল্লাহ আমাকে দিবে। 

এ্মনই হয়। দু:খ, রাগ, হতাশার মূহুর্তে ফেটে না পড়ে কোন মতে ধৈর্য ধরে সময়টা কাটিয়ে দিতে পারলে আল্লাহ এর অনেক বেশি ভাল কিছু দিয়ে তার প্রতিদান দেন। কালকে রাত থেকে কেবল ভাবছিলাম, আমি এভাবে দিনের পর দিন পার করে দিচ্ছি – না একটা চ্যারিটি করি, না একটা ইবাদত করি, না ঘরটাকে আরো ভাল করে বাস করার উপযোগী করি – আমি আসলে করছি টা কী? জানি, এখন আমাকে পড়াশুনা করতে হবে, তাই ওটা ছাড়া অন্য কিছুতে ঠিকমত সময় দিতে পারবনা – এটা আমাকে মেনে নিতে হবে। কিন্তু, যে পড়ার জন্য অন্য সব কিছুকে বাদ দিচ্ছি তা আসলে কতটুকু worth? 

ইংরেজিতে এর্ একটা রেডিমেড এক্সপ্রেশন পেয়ে গেছি। I don’t see any light in the end of the tunnel, what i mi doing and why i am doing it… রেহনুমা বিনতে আনিসের এক লেখায় আরো সুন্দর একটা লাইন পড়েছি। ‘জীবিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে জীবনের উদ্দেশ্যটাই হারিয়ে গেছে মাঝপথে কোথাও।’ রাসুলুল্লাহ (স) এর কথা ভাবছিলাম, উনি ছিলেন the most balanced person. কীভাবে সামলাতেন সবকিছু – তাই ভাবছিলাম অবাক হয়ে। 

আসলে ছোটবেলা থেকে আমি একটা আইডিয়া নিয়ে বড় হয়েছি, যে পড়াশুনা এবং কেবলমাত্র পড়াশুনাই আমার একমাত্র কাজ। আমার সর্বংসহা মা আমাদের কে পড়ার টেবিলে দেখার বিনিময়ে ঘরের বাইরের সব কাজ থেকে আমাকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। আমার অতিরিক্ত স্নেহবৎসল বাবা ইউ এস এ আসার দুই মাস আগে যখন ড্রাইভিং শিখতে চেয়েছিলাম, তখনও আঁতকে উঠে বলেছিলেন, না না মা খবরদার! ্অ্যাক্সিডেন্ট করে বসবা। 

এই হচ্ছে আমার ফ্যামিলি। নিজেরা অনেক স্ট্রাগল করে পড়াশুনা, ক্যারিয়ার অর্জন করেছেন, তাই জানেন এর মূল্য কত। তাই সবসময় কেবল চেয়েছেন সাপের মাথার মনিটুকু আমার সন্তানেরা পাক, সাপটাকে নাহয় আমিই গায়ে জড়িয়ে রাখব। কিন্তু বাবা বোঝেনি জীবনটা অনেক বড়, পদে পদে সাপ পা পেঁচিয়ে ধরতে চায়। আমি কেবল অসহায়ের মত বাবা কে, মা কে খুঁজি, আর নিজের অক্ষমতায় নিজেকেই কেবল গাল পাড়ি। 

একটা সফল জীবন মানে যে not just a beautiful career, একটা balanced জীবন – এটাও আমাকে নিজে নিজে উপলব্ধি করতে হয়েছে (অবশ্য আশপাশের মানুষজন কে দেখে ভরসা পাই, অনেকে জীবনের অন্তিম লগ্নে পৌঁছেও এখনও টের পায়নি।) ভার্সিটিতে পড়াকালে আব্বুর উপর খুব রাগ হত, তুমি তোমার গ্রামের মানুষের জন্য স্কুল কর, পোস্ট অফিস বানাও, আমি কিছু করতে গেলে নিষেধ কর কেন? বাবা বলত, তুমি এইসব বুঝবা না, মানুষজনের মধ্যে কত রকমের জটিলতা তুমি সেসব সামলাতে পারবানা। এই ছোট মানুষ, বুঝবানা – এই করে করে বড় হয়ে গেলাম, ধারণা ছিল বড় হলে সব এমনিতেই বুঝে যাব। দীর্ঘশ্বাস, ছোট ছোট ব্যাপার, যা অনেক ছোটকালেই বোঝা উচিৎ ছিল – এখন তা এই বয়সে এসে শিখতে হচ্ছে।

অবশ্য সবসময় যদি দেশের বাইরে থাকি, পিএইচডি শেষ করে কোনমতে পোস্টডক বা রিসার্চ এসিস্ট্যান্টশিপ জুটিয়ে ফেলি, বছর বছর অনেক শপিং করে দেশে বেড়াতে যাই তাহলে আর অত অসুবিধা হবেনা। কোনমতে being nice to people এর কলাকৌশলগুলি শিখে ফেলব, কাদায় কখনো পা ও পড়বেনা। সাপ? বরফের দেশে সাপ নাই।

যাই হোক, এসব ভাবছিলাম আর কষ্ট লাগছিল। আল্লাহ প্রতিটা মানুষকে কী অমিত সম্ভাবনা দিয়ে তৈরি করেছেন… আর আমরা কী করছি! এই রোবোটিক জীবন কাটানোর জন্য ত এত জটিল বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রজাতি তৈরির দরকার ছিলনা। আমি শুনেছি জ্বীন ও মানুষকে আল্লাহ ইবাদত করার জন্যই কেবল তৈরি করেছেন। কিন্তু purpose of life হিসেবে দিনরাত আল্লাহ আল্লাহ বলে জিকির করাটা ঠিক যথেষ্ট মনে হচ্ছিলনা। নিশ্চয়ই আমরা ইবাদত ই করব, কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই হবে আমাদের ইন্টেলেক্ট এবং আমাদের মনুষ্যত্বের মাধ্যমে। নিজেকে মাপছিলাম। মনুষ্যত্ব দেখানোর জন্য যে সোশ্যাল স্কিলগুলি দরকার হয়, সেটা অর্জন করার সুযোগ বেশি একটা হয়নি। আর ইন্টেলেক্ট কে গত ২০-২২ বছরের একাডেমিক পড়াশুনায় এমনদিকে নিয়ে গিয়েছি যে বিবর্তনবাদের ফিকশন অনেক বেশি লজিক্যাল লাগে। যে বায়োলজি নিয়ে আমার এতদিনের পড়াশোনা, সেখানেই নাস্তিকতাবোধ এত দৃঢ়, সোশ্যাল সায়েন্স, ইকোনমি, পলিটিকস – এসব ভাসাভাসা ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা ত রীতিমত অসম্ভব! 

সবকিছু মিলায় চিন্তা করে দেখি, একজন মানুষ হিসেবে যে ইবাদত টা করার কথা তা আমি করছিনা। আমার ধর্ম পালনের সাথে একটা গাছের, একটা পিপড়ার জিকিরের কোন পার্থক্য নেই। মানুষ হিসেবে অন্যান্য প্রাণী থেকে আমি নিজেকে যেসব বিষয়ে সুপেরিয়র ভাবি, তার কোনটার চর্চাই আমাকে আল্লাহর কাছাকাছি এনে দিচ্ছেনা। ইনফ্যাক্ট ফেরেশতা, যারা কিনা আল্লাহর অবাধ্য হতে জানেই না, তাদের চেয়েও আল্লাহ আমাদের সুপেরিয়র করে তৈরি করেছেন। সূরা ত্বীন এর কয়েকটা লাইন ্ এত সুন্দর –

লাক্বাদ খালাকনাল ইনসানা ফী আহসানি তাকয়ীম (নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সর্বোৎকৃষ্ট রূপে তৈরি করেছি)

সুম্মা রাদাদনা হু আসফালা সাফীলিন (তারপর সে নিকৃষ্টর চেয়েও নিকৃষ্টতর হয়ে যায়)

চলবে … (ইনশাল্লাহ)

Collected From

Sister

Nusrat Rahman

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *