প্রথমেই জেনে রাখা উচিত, মদিনার সনদ সম্পূর্ণরূপে সংরক্ষিত নয়। এর বেশ কিছু অনুচ্ছেদ মিসিং। তবে যেটুকু বিশুদ্ধ সনদে সংরক্ষিত আছে তা দিয়েও কোনোভাবেই একে ধর্মনিরপেক্ষ সনদ হিসেবে প্রমাণ করা সম্ভব না।
ইসলামী রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হলো ইসলাম। ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ চায় ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে। এখানে রাষ্ট্রধর্ম বলতে কিছু নেই। কিন্তু মদিনার সনদে কি রাষ্ট্রধর্ম বলতে কিছু ছিলো না?
মদীনায় হিজরতের পূর্বে মুসলিমদের উপর এটা ফরজ ছিলো যে মুহাম্মদকে (সঃ) তারা নবী ও রাসূল হিসেবে মেনে নিবে। আর হিজরতের পর উম্মতের উপর তাঁকে নবী ও রাসূলসহ একজন রাষ্ট্রনেতা হিসেবেও মেনে নিবে। আর সে রাষ্ট্রের মূলভিত্তি অবশ্যই ইসলাম।
মদিনার সনদে সমতা ছিলো ঠিক, কিন্তু এর মূলভিত্তিও ছিলো ইসলাম। ইসলাম যে সমতাকে ঘোষণা করেছে সেই সমতার বাহিরে অন্য কোনো কথিত সমতা এতে ছিলোনা। এর একটি অনুচ্ছেদ হলো- “কোনো মুমিন কাফেরের জন্য অন্য মুমিনকে হত্যা করতে পারবেনা, কোন মুমিনের বিরুদ্ধে কোনো কাফেরকে সাহায্য করতে পারবেনা”। এখন এই মদিনা সনদের এই অনুচ্ছেদ কি বর্তমান সেক্যুলাররা মেনে নিবেন?!
এবং সবকিছুর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে আল্লাহ ও রাসূলের সিদ্ধান্ত মোতাবেক। অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- “আর যখনই তোমরা কোন মিমাংসায় পৌছাতে পারবেনা তখন এর সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে আল্লাহ ও মুহাম্মদ (সঃ) এর বিধান অনুযায়ী”।
আরো দেখুন কি ছিলো সেই সনদে- “আল্লাহর দায়িত্ব সবার জন্যে সমান, যেখানে সর্বনিম্নজনকেও আশ্রয় দেয়া হবে। আর মুমিনরা এক অপরের অভিভাবক থাকবে অন্য লোক ব্যতিত”।
“সকল মুমিনের চুক্তি একটাই, আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধের বিষয়ে তাঁরা কেউ কাউকে বাদ দিয়ে চুক্তি করতে পারবেনা, ন্যায় ও ও সমতার ভিত্তিতে”।
সুতরাং মদিনার সনদের মূল দুইটি অংশের একটি হলো- ঈমান ও আকীদার বিষয়ে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল ছিলেন সর্বেসর্বা। অন্যটি হলো- রাষ্ট্রীয় সংবিধানের ক্ষেত্রেও আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে সর্বোচ্চ বিধানদাতা হিসেবে মানতে সকলে বাধ্য ছিলো। এ কারণেই মদীনাবাসীর জন্য আল্লাহর রাসূলের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক ছিলো ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে।
কারণ, মক্কায় রাসূলের দায়িত্বে কোনো রাষ্ট্র ছিলোনা। তাই সেখানে রাষ্ট্রীয় বিধিবিধানের প্রয়োজন ছিলোনা। মদীনায় মুহাম্মদ (সঃ) একাদারে মুসলমানদের নবীও ছিলেন, জনসাধারণের রাষ্ট্রনেতাও ছিলেন। কিন্তু সেখানে মক্কার মতোই সংবিধান ছিলো আল-কোরআন। শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় বিধানকে চুক্তিপত্রের রূপে প্রণয়নের জন্যেই আলাদা করে মদিনা সনদ লিপিবদ্ধ করা হয়েছিলো; যা কোরআনেরই নির্যাস।
নতুন রাষ্ট্রের এই সকল বিধি বিধান শুধুমাত্র মদীনা সনদ দ্বারাই নির্নিত ছিলোনা। বরং ততদিন পর্যন্ত নাযিলকৃত কোরআন, প্রথম বাইয়াতে উকবা, দ্বিতীয় বাইয়াতে উকবা সহ মদিনা সনদ সব মিলিয়ে রাষ্ট্রীয় বিধানের অবকাঠামো নির্ধারিত। এর প্রয়োজন ছিলো, কারণ তখনও কোরআন পূর্ণভাবে নাযিল হয়নি। সুতরাং এখানে সংশয়ের অবকাশ নেই যে এই সব উপাদানের সমীকরণ রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামকেই বাস্তবায়নের পথে ছিলো।
নবী হিসেবে মুহাম্মদের (সঃ) প্রতিটি নির্দেশ ও নিষেধ যেমন শিরোধার্য ছিলো, তেমনি রাষ্ট্রনেতা হিসেবেও তাঁর প্রতিটি বাক্য মেনে নেয়া বাধ্যতামূলক ছিলো। আর তাঁর কাছে আসা ধর্মীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় সব নির্দেশই ছিলো আল্লাহর অহী। তদানীন্তন মদীনার মুসলিম-অমুসলিম সকলেই নির্বিশেষে জানতেন- রাসূলের প্রতিটি নির্দেশই মানতে হবে; হোক তা ধর্মীয় কিংবা রাষ্ট্রীয়। এ কারণেই তিনি ইহুদিদের জন্য ধর্মীয়ভাবে কিছুই চাপিয়ে দেননি। তাদেরকে ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি যদি চাইতেন ইহুদিদেরকে ধর্মীয়ভাবে কিছু নির্দেশ দিতে তাও তিনি পারতেন, কিন্তু সেটা তাঁর পছন্দ ছিলো না। এবং এটাও কোরআনের নির্দেশ মোতাবেকই তিনি করেছেন। এ কারণেই তিনি বিশ্বজগতের জন্য রহমত ছিলেন। যে কোরআন অমুসলিমকে ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছে সেই কোরআনই তো রাষ্ট্রীয় সংবিধান। সেই কোরআনের প্রয়োগিক রূপ ইসলামই সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রধর্ম।