ইমাম আহমদের নামে একটা কাল্ট তৈরী করে

Hujaifa Mahmud

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ: এর প্রতি এই উম্মতের প্রত্যেক সদস্যই আলাদা একটা টান,শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা লালন করে। সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে আমরা তাঁকে স্মরণ করি। তার প্রতি মানুষের এই অভূতপূর্ব ভালোবাসার টান তার জীবদ্দশাতেই তিনি দেখে গিয়েছিলেন। এর অন্যতম কারণ হলো সত্যের পথে তার আপোষহীন সংগ্রাম এবং বাতিলের মোকাবেলায় পাহাড়সম দৃঢ়তার উপাখ্যান। তার সেই অবিস্মরণীয় সংগ্রামের মাধ্যমেই আল্লাহ উম্মতকে বড় একটি ফিতনা থেকে বাঁচিয়েছেন।

কিন্তু দু:খজনক ব্যাপার হলো আহমদ ইবনে হাম্বল রহ: এর মৃত্যুর পর তার একদল অনুসারী এই তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার অন্যায় ব্যাবহার শুরু করে। তারা ইমাম আহমদের নামে একটা কাল্ট তৈরী করে বসে। এবং নিজেরা মাফিয়া টাইপের আচরণ করা শুরু করে, সোজা কথায় ইসলামি জ্ঞানশাখার সকল ময়দানে গুন্ডামি করতে শুরু করে। নিজেদের কে “আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাহর” একমাত্র বিশুদ্ধ আকীদার একচ্ছত্র কর্তৃপক্ষ হিসেবে দাবী করে বসে। তারা যা যা বলে, যেভাবে বলে ঠিক সেভাবে কেউ যদি না বলে তাহলেই সে আর আহলুস সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত না। সময়ের শ্রেষ্ঠ আলেম,ইমাম ,মুহাদ্দিস ও মুজতাহিদদের সাথে তারা এধরণের আচরণ করেছে।

খালকে কুরআন সম্পর্কে ইমাম বুখারি রহ: এর বক্তব্য আর মু’তাযিলাদের খালকে কুরআনের ব্যাপারে বক্তব্য নি:সন্দেহে এক না। ইমাম বুখারির নিজস্ব বক্তব্য ও ব্যাখ্যা আছে। তিনি একজন মুজতাহিদ এবং তার সময়ের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস । এতদসত্তেও তাঁর বক্তব্য যেহেতু হুবুহু ইমাম আহমদের বক্তব্যের সাথে মিলেনি তাই তাকে অপমান অপদস্ত করে শহর থেকে তাড়িয়ে দেয়া হলো , এমনকি তাঁর বক্তব্য ভালো করে শুনা বা বুঝার আগেই। তার জীবনকে সংকীর্ণ বানিয়ে ফেললো তারা। অনন্যোপায় হয়ে তিনি নিজের মৃত্যু কামনা করলেন আল্লাহর কাছে।

একইভাবে ইবনে জারির তবারি রহ:, যিনি তার সময়ের শ্রেষ্ঠ মুহদ্দিস,ইতিহাসবিদ এবং মুফাসসীর। তার কোন এক বক্তব্য হাম্বলীদের পছন্দ হয়নি, সেজন্য তারা তাকে জুমার মিম্বারে অপদস্ত করেছে। তিনি তাদের রোষানল থেকে বাঁচার জন্য নিজের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন। তখন তারা তার ঘরে পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। পাথরের স্তুপ জমে তার ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।

আবু হাতেম ইবনে হিব্বান রহ: এর মতো যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসকে কাফের ফতোয়া দিয়ে বের করে দেয়া হয় শহর থেকে। ” ইসতাওয়া আলাল আরশ” সম্পর্কে তিনি তাদের মন:পূত ব্যাখ্যা গ্রহণ করেন নি।

এরকম হাজারো ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় ইতিহাসের কিতাবগুলো তে। এবং আজকের দিনের “সহীহ আকীদার” একমাত্র কর্তৃপক্ষ সেজে বসে থাকা শায়খরাও মূলত সেই সিলসিলারই বর্ধিত অংশ। ইনাদের ভাবসাব দেখলে ওইসময়ে তাদের দৌরাত্ম্য কতটা ভয়াবহ ছিলো তারও একটা নমুনা পাওয়া যায়।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ: উম্মাহর মাথার তাজ। আমাদের হৃদয়ের গভীর উষ্ণতম জায়গায় তার বাস। এই উম্মাহ কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর প্রতি ঋণী থাকবে।

কিন্তু এসবের পাশাপাশি একথাও সত্য, তিনি এই উম্মাহর একমাত্র ইমাম বা মুজতাহিদ নন। বরং আল্লাহ তার দ্বীন কে পৃথিবীর বুকে যেসব মহান মানুষদের মাধ্যমে টিকিয়ে রেখেছেন তিনি তাদের অন্যতম একজন। একই কথা ইবনে তাইমিয়া রহ: এর ক্ষেত্রেও।

সুতরাং ,যারা মনে করেন কোন আকীদার কোন বিষয়ে ইমাম আহমদ রহ: কিংবা ইবনে তাইমিয়া কথা বললে আর কারও সে বিষয়ে নাক গলানো বা কথা বলা উচিৎ না, তাদের এই চিন্তার যৌক্তিক কোন ভিত্তি নাই।

বরং ফিকহের মতো আকীদাও অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত বিষয়। এখানে قطعي الدلالة নুসুসের মাধ্যমে স্থির ও সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্তকৃত বিষয় যেমন আছে, তেমনই ظني الدلالة নুসুসের কারনে ইজতেহাদের ক্ষেত্রও অনেক প্রশস্ত। আজকে আমরা আকীদার যে বিষয়গুলো কে বড় বড় শিরোনাম আকারে সাজিয়ে পাঠ করছি, সাহাবাদের সময়ে তাঁরা এগুলোকে এরকম শিরোনাম আকারে পাঠ করেন নি। আল্লাহ কোথায় আছেন, কিভাবে আছেন, আকার আকৃতি আছে কি নেই, এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে লিপ্ত হননি তারা। দুয়েকটা ব্যাতিক্রম উদাহরণ বাদে এগুলো নিয়ে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ও তর্ক বিতর্ক করা কে তারা অপ্রয়োজনীয় ও বিপদজনক হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। এসব সূক্ষ্ম আলোচনা ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন দেখা দেয় আরও বহু পরে।

আল্লাহর যাত ও সিফাত অসীম। এর কোন সীমা পরিসীমা নাই। অপরদিকে আমাদের ভাষা, জ্ঞান, চিন্তা ও কল্পনা সবটাই সীমিত এবং গন্ডিবদ্ধ। ফলে এই সীমিত ভাষা, জ্ঞান,ও চিন্তা দিয়ে যখন আমরা আল্লাহর অসীম যাত ও সিফাত কে বুঝতে যাই তখন স্বাভাবিকভাবেই বহুবিধ জটিলতা তৈরী হয়।

সুতরাং আকীদার যেসব বিষয় ইজতেহাদ নির্ভর সেগুলোকে ইজতেহাদি বিষয় হিসেবেই বিবেচনা করা উচিৎ এবং উম্মাহর আরও যেসব স্বিকৃত ইমাম ও মুজতাহিদগন মতামত পেশ করেছেন তাদের মতামতকেও সম্মানজনক জায়গা দেয়া উচিৎ। ইজতেহাদি বিষয় কে ক্বতঈ বিষয় বানিয়ে সেটা সকলের উপর চাপিয়ে দেয়া, এবং না মানলে তাকে খারিজ করে দেয়া মোটেও গ্রহনযোগ্য কোন মানহাজ না।

খুবই আফসোস হয়, আবার হাসিও পায় যখন দেখি একদল লোক ,সকাল বিকাল নিয়ম করে একটা কথাই বারবার বলে যাচ্ছেন ” দেখুন, আশআরি মাতুরিদিরা কিন্তু আহলুস সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত না, তারা বিদাতি, জাহমি, আল্লাহর সীফাত অস্বীকারকারী।”

উম্মাহর বৃহত্তর অংশটাই বিদাতি, আহলে সুন্নাহ থেকে খারিজ, কারন তারা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ: এবং আরও কয়েকজনের ইজতেহাদি মতামতগুলোর অনুসরণ না করে অন্য কোন ইমামের ইজতেহাদ অনুসরণ করছে। কারণ ,আকীদার বিষয়ে তাদের ইমাম যা বলেছেন তারপরে আপনার আর ভিন্নমত করার কোন সুযোগ নাই!

তাদের বক্তব্যের মজার ব্যাপারটা হইলো, তারা আমার আপনার মতো গোবেচারা সাধারণ মানুষকে আশআরি মাতুরিদি হওয়ার কারণে সকাল বিকাল আহলুস সুন্নাহ থেকে খারিজ করে দেন। কিন্তু ইনারাই আবার হাফেজ ইবনে হাজার ,ইমাম নববী কিংবা ইবনে কাসীর রহ: এর মতো ইমামদের ব্যাপারে ঝটপট বক্তব্য পাল্টে ফেলেন। তাদের ব্যাপারে শায়েখদের সিদ্ধান্ত হলো – তাদের বক্তব্য যদিও আশাআরি মাতুরিদি আকীদার মতো শোনা যায়,কিন্তু তারা মূলত আশআরি আকীদার ছিলেন না। তারা বিশুদ্ধ আকীদার লোক ছিলেন। তাদের বক্তব্য আশআরিদের সাথে মিলে গেলেই যে তারাও আশআরি হয়ে যাবেন এমন কোন কথা নাই। সুতরাং তারা বাহ্যিকভাবে আশআরিদের মতো আকীদা লালন করলেও তারা মূলত আমাদের ইমাম। লাজনাতুদ দায়েমা থেকে শুরু করে আরবের প্রখ্যাত সকল সালাফি শায়েখই এমনটা মনে করেন। কেউ কেউ আবার কল্পিত রুজু’এর গাল গল্পও জুড়ে দেন তাদের সাথে। কারণ তাদের রেখে যাওয়া ইলমের তুরাস থেকে অমুখাপেক্ষী হয়ে থাকা কে এফোর্ড করা সম্ভব না। আশআরি বিদাতি বলে ফেলে দেয়ার ক্ষমতা নাই।

ফলে সালাফি সমাজে এটা একটা অমিমাংসিত ব্যাপার হয়েই রয়ে গেছে বটে- ইবনে হাজার ইমাম নববি প্রমুখগন কি বিদাতি শয়তান ( মাআযাল্লাহ) ছিলেন নাকি আহলুস সুন্নাহর ইমাম ছিলেন ! তাদের লিখিত কিতাবগুলো পুড়িয়ে ফেলা উচিৎ কি না এরকম প্রশ্নও রয়েছে তাদের ফতোয়ার ওয়েব সাইটগুলোতে।

ভাবছি এ কেমন বিচার তাদের। ইবনে হাজার ,নববি এবং তাদের মতো ইমামগনের প্রায় সকলেই তাদের সারা জীবনে সিফাতের ক্ষেত্রে কখনও তাবিল করেছেন কখনও তাফবিদ করেছেন। এতোকিছুর পরও তারা তাদের ইমাম হয়েই রইলেন। আর আমরা আজ গরীব বলে, ফাতহুল বারির মতো কোন কিতাব লেখতে পারিনাই বলে আহলুস সুন্নাহ থেকেই খারিজ হয়ে গেলাম। ????

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *